ঢাকা,রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল : পশু আর মানুষের লাশ হয়েছিল একাকার

নিজস্ব প্রতিবেদক ::

আজ থেকে ২৭ বছর আগে ‘১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সোমবারে প্রতিদিনের মত আমার ৩ সন্তানের মধ্যে হ্যাপি (৫) আর মোহাম্মদ হেলাল (৮) বাড়ির উঠানে খেলছিল। আর ৮ মাসের হালিমা ছিল কোলে। সেদিন সকাল থেকে হ্যাপি আর হেলাল খুব ছুটোছুটি করছিল। আজও স্পষ্ট মনে পড়ে হ্যাপি খেলছিল আমার লাল ওড়না নিয়ে। আর মোহাম্মদ হেলাল দৌড়ঝাপ করছিল। বাচ্চাদের এই দৃশ্য দেখে খুব ভাল লাগছিল। আবার কেন জানি ভয়ও হচ্ছিল। বার বার মনে হচ্ছিল এই সুখ কপালে সইবেতো। কিন্তু প্রকৃতির কি খেলাÑঠিকই সেই রাতের ভয়ংকর ঘুর্ণিঝড়ে হারিয়েছি প্রাণ প্রিয় ৩ সন্তানকে। আমি এখনও ভুলতে পারিনা আমার সন্তান হারার সেই মুহুর্তগুলো। ওই স্মৃতি মনে পড়লে মুখে খাবার তুলতে পারিনা। মন চায় চিৎকার করে কান্না করি। তখন আর কিছুই ভাল লাগেনা। শুধু আমি নয়, আমার স্বামীও নিরবে কান্না করে সন্তানদের জন্য। এসব কথা বলতে গিয়ে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল কক্সবাজার শহরের কুতুবদিয়া পাড়ার ছকিনা বেগমের (৪৮)। ছকিনা দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার বড়ঘোপের লামার বাজারের নুরুল ইসলামের স্ত্রী। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ৩ সন্তানসহ পরিবারের ১২ সদস্য ও ভিটে-বাড়ি হারিয়ে কক্সবাজার শহরের কুতুবদিয়া পাড়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। ওই পাড়ার বেশিরভাগ লোক’ই ঘূর্ণিঝড়ে মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্থ কুতুবদিয়ার বাসিন্দা। তাই এলাকাটির নামও কুতুবদিয়া পাড়া।
ভয়ংকর সেই রাতে সন্তান হারানোর বর্ণনা দিতে গিয়ে ছকিনা বেগম জানান, ‘ওই দিন দুপুর পর্যন্ত মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে বাতাস শুরু হয়। রাতে চলে প্রবল ঝড় আর বাতাস। ওই সময় আমার স্বামী ছিল পাশের গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। অবস্থা দেখতে বাহিরে আসতেই দেখা যায় উঠানে পানি। আর মুহুর্তের মধ্যে ওই পানি কোমর পর্যন্ত। সাথে ছিল প্রচন্ড ¯্রােত। তখন বাচ্চাদের নিয়ে ঘরের গুদামে উঠে যাই। গুদামে উঠার একটু পরেই ওখানে পানি উঠে যায়। আর মুহুত্বে মধ্যেই বড় বড় ঢেউ ধাক্কা দিচ্ছিল গুদামে। আর একটু পরেই সব লন্ড-ভন্ড। কখন যে ৮ মাসের হালিমা বুক থেকে চলে গেছে জানিনা। হ্যাপি ছিল তার দাদির হাতে। হেলাল ছিল আমার হাতে। আমরা মা-ছেলে যখন ভেসে যাচ্ছিলাম তখন আমার সন্তান বার বার বলছিল মা আমি পানি খাচ্ছি আমাকে বাচাঁও। কিন্তু শত শক্তি দিয়েও আমার ছেলেকে উপরে উঠাতে পারছিলামনা। তারমধ্যে চারদিকে ছিল অন্ধকার। এরই মধ্যে চিৎকার শুনতে পাই আমার মেয়ে হ্যাপির। তার দাদি তাকে নিয়ে একটা উচু গাছে উঠে ছিল। হেলালকে নিয়ে কোনভাবে সেই গাছ পর্যন্ত যাওয়া গেলেও গাছের উপরে থাকা লোকজনগুলো আমাদের টেনে তুলেনি। এরই মধ্যে হেলালও আমার হাত থেকে ছুটে যায়। আর আমি তলিয়ে গিয়েছিলাম পানির নীচে। এরপর আর কিছুই জানিনা। পরদিন সকালে আমার জ্ঞান ফিরে আমি একটি গাছের ফাঁকে আটকা অবস্থায়।পরে লোকজন আমাকে গায়ে কাপড় পড়িয়ে দেয়। এরই মধ্যে সব শেষ হয়ে গেছে আমার। আমি নিজেই সনাক্ত করতে পারছিলামনা আমার ঘরটি কোথায় ছিল। কারন চারদিকে থৈ থৈ পানি। আর ওখানে ভাসছে লাশ আর লাশ। পশু আর মানুষের লাশ হয়েছিল একাকার। পাগলের মত হন্যে হয়ে খোঁজছিলাম সন্তানদের। একটু দুরেই পেলাম সেই লাল ওড়না প্যাচানো অবস্থায় হ্যাপির লাশ। ওই মুহুর্তগুলো মনে পড়লে আজও বুক ভেঙ্গে যায়। খোঁজে পায়নি আমার বাকী ২ সন্তানের লাশ। একদিন পরে আমার স্বামী আমাকে খোঁজে পায়। এরপর জানতে পারি আমার ৩ সন্তানসহ ১২ জন আত্বীয় মারা যায় এই ঘূর্নিঝড়ে। এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ছকিনা বেগম’। এই গল্প একজন ছকিনা বেগমের। কিন্তু হাজার হাজার ছকিনার রয়েছে এর চেয়ে ভয়াবহ গল্প। কক্সবাজারের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলবর্তী এলাকায় এমনও পরিবার রয়েছে যাদের একজনও বেঁচে নেই। কারো কারো পুরো একটি গোষ্টির মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র একজন।
১৯৯১ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্নিঝড়ে কক্সবাজার টেকনাফ, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া সহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপকুলীয় এলাকা লন্ড-ভন্ড হয়ে গেছে। সরকারী হিসাবে অনুযায়ী দেড় লাখ লোক মারা যাওয়ার কথা বললেও এই সংখ্যা ২ লাখের বেশি। এছাড়া মারা গেছে ৩০ হাজারের বেশি গবাদি পশু। গৃহহারা হয়েছে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ।
আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, এ সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘন্টায় ২৫০ কিলোমিটার। জলোচ্ছাসের উচ্চতা ছিল ২০ ফুট। রাতের আধারে আঘাত হানা এই ঘূর্ণিঝড়ে গাছের ডালে, ঘরের চালে, খাল-বিল, নদী-সাগরে ছিল শুধু লাশ আর লাশ। পশু আর মানুষের লাশ একাকার হয়ে গিয়েছিল।
এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রসঙ্গে কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরং এর চেয়ারম্যান আ ক ম শাহরিয়ার জানান, কুতুবদিয়ায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ দরকার। সেই ১৯৯১ সালের পর থেকে প্রতিবছর বেড়িবাধ করা হয় আর প্রতিবছরই নষ্ট হয়। এই বেড়িবাঁধ নিয়ে চলে দূর্নীতি। এতে সরকারের টাকাও নষ্ট হয় কাজের কাজও কিছুই হয়না। তাই তাদের প্রত্যাশা একটি স্থায়ী বেড়িবাঁধ।
বান্দরবান জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী রাকিবুল হাসান জানান, কুতুবদিয়ায় ১৩৭ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। এতে নৌ-বাহিনীর তত্বাবধানে ৯৭ কোটি টাকা ও ঠিকাদারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে ৪০ কোটি টাকার বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ। মোট সাড়ে ১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মিত হবে। এতে সাড়ে ৪ কিলোমিটার হবে সিসি ব্লক দিয়ে আর ৯ কিলোমিটার হবে মাঠির কাজ। ইতোমধ্যে সিসি ব্লকের কাজ মাত্র শুরু হয়েছে। মাটির কাজ হয়েছে দুই কিলোমিটার। তবে আসন্ন বর্ষায় যাতে কোন গ্রাম জোয়ারের পানিতে প্লাবিত না হয় সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালের জুনের মধ্যেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

পাঠকের মতামত: