উপকূলে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু আঘাত হানার ইতিমধ্যে আটদিন পেরিয়ে গেছে। ওইদিন কয়েকঘন্টার তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় কক্সবাজারের পেকুয়ার মগনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া ও পেকুয়া সদর ইউনিয়ন। সমুদ্র তীরের এসব ইউনিয়নের রক্ষাকবচ অন্তত ১৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ ও আংশিক বিলিন হয়ে যাওয়ায় এবং ভাঙা অংশ দিয়ে প্রতিদিন সামুদ্রিক জোয়ার–ভাটা অব্যাহত রয়েছে। এতে উপজেলার ৩০ হাজার মানুষ এখন জোয়ার–ভাটার বৃত্তে বন্দি হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থায় সম্পূর্ণ বসতবাড়ি হারানো প্রায় দুই হাজার পরিবার এখনো খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করছেন। তার ওপর ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে প্রতিদিন দুইবার তলিয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগ আরো চরমে পৌঁছেছে।
সংশিষ্টরা জানান, দিনে দুইবার সামুদ্রিক জোয়ার–ভাটার পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে অন্তত ৩০ হাজার মানুষকে। গত ২১মে ঘূণিঝড় রোয়ানুর তাণ্ডব এবং পূর্ণিমার ভরা তিথীতে সাগরে পানি বৃদ্ধি পায়। এ সময় সামুদ্রিক জোয়ারের প্রচণ্ড ধাক্কায় উপকূলবর্তী চার ইউনিয়নের রক্ষাকবচ পানি উন্নযন বোর্ডের অন্তত ১৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সাগরে বিলীন হয়ে যায়। কোন কোন এলাকায় বড় বড় খাদেরও সৃষ্টি হয়েছে ভাঙা বেড়িবাঁধে। বর্তমানে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে এই চার ইউনিয়ন, প্রতিদিন দুইবার করে প্লাবিত হচ্ছে সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে। উজানটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম জানান, করিয়ারদিয়াসহ ইউনিয়নের একাধিক স্থানে বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে।
বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে গত ৮দিন ধরে দুইবার করে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় করিয়ারদিয়া, ষাটদুনিয়া পাড়া, টেক পাড়া, ফেরাসিংগা পাড়া, পেকুয়ার চর, নতুন ঘোনাসহ উজানটিয়া ইউনিয়নের সব এলাকায় কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। মগনামা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম জানান, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর তাণ্ডবে ইউনিয়নের অন্তত ৬০ চেইন বেড়িবাঁধ সাগরে বিলিন হয়ে গেছে। এতে নিয়মিত জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে ঘাট মাঝির পাড়া, উত্তর পাড়া, পুরাতন বহদ্দার পাড়া, হারুন মাতবর পাড়া, বৃন্দার পাড়া, লাল মিয়া পাড়া, হারঘর পাড়া, শরৎ ঘোনাসহ পুুরো ইউনিয়নে। রাজাখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছৈয়দ নূর জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় নতুন ঘোনা, বকশিয়া ঘোনা, চরি পাড়া, মৌলভী পাড়া, আমিলা পাড়া, পালাকাটা, দশের ঘোনা, নতুন পাড়া, বদিউদ্দীন পাড়া, বামুলা পাড়া, সুন্দরী পাড়া, মাতবর পাড়াসহ পুুরো ইউনিয়ন ব্যাপকভাবে প্লাবিত হচ্ছে। পেকুয়া সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহ্ জানান, ইউনিয়নের ছিরাদিয়া অংশে বেড়িবাঁধ বিলীন হওয়ায় মাতামুহুরী নদীর জোয়ার–ভাটার প্রচণ্ড স্রোত লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এতে ইউনিয়নের ছিরাদিয়া, বিলাহাচুরা, গোঁয়াখালী, জালিয়াখালী, হরিণাফাঁড়ি, নন্দীর পাড়াসহ বিশাল এলাকা জোয়ার–ভাটার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।
পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মারুফুর রশিদ খান বলেন, ‘ঘুর্ণিঝড় রোয়ানুর তাণ্ডবে ১৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলিন হয়ে গেছে সাগরে। এতে প্রতিদিন জোয়ার–ভাটা অব্যাহত রয়েছে চার ইউনিয়নে। এই অবস্থায় মানুষের দুর্ভোগও বেড়ে গেছে ব্যাপক। তাই বসতবাড়ি হারানোর পরিবারগুলোকে সরকারীভাবে পুনর্বাসনে সহায়তা করার আগে জরুরীভিত্তিতে বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ শেষ করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছি। পেকুয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ চৌধুরী রাজু বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর তাণ্ডবে বেড়িবাঁধ লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ায় গত আটদিন ধরে চার ইউনিয়নের ৩০ হাজার মানুষ জোয়ার–ভাটার বৃত্তে বন্দি হয়ে পড়েছে। পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে গ্রামীণ অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, এমনকি কবরস্থানও। অতি শিগগিরই বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ শেষ করা না হলে চার ইউনিয়নকে সমুদ্রের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই অবস্থায় চরম খাদ্য সংকটেও ভুগছে পানিবন্দি এসব মানুষ। যাদের ভিটে থেকে বসতবাড়ি সম্পূর্ণ উপড়ে গেছে, সেই ভিটায় নতুন করে বসতিও স্থাপন করা যাচ্ছে না জোয়ার–ভাটা অব্যাহত থাকায়। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণই জরুরি হয়ে পড়েছে।’ এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর তাণ্ডবে সমুদ্রতীরের উপজেলা পেকুয়া চার ইউনিয়নের পাঁচ কিলোমিটার সম্পূর্ণ এবং চৌদ্দ কিলোমিটার আংশিক বিলিন হয়ে গেছে। সামুদ্রিক জোয়ার–ভাটার কবল থেকে মানুষগুলোকে পরিত্রাণ দিতে আগামী বৃহস্পতিবার বা শুক্রবারের মধ্যে কাজ শুরু করে দেওয়া হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অর্থ বরাদ্দ এবং দিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে।’
পাঠকের মতামত: