ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

পেকুয়ায় ইমামকে ফাঁসাতে ভাগ্নিকে ধর্ষণ করে ফেঁসে গেলেন মামা-মামি

এম জাহেদ চৌধুরী :: কক্সবাজারে জমির বিরোধ নিয়ে প্রতিপক্ষ এক মসজিদের ইমামকে ফাঁসাতে আপন ভাগিনি শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করে উল্টো ফেঁসে গেলেন মামা-মামি ও এক ইউপি সদস্য। তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার বিচক্ষণতায় মূল ঘটনা বেরিয়ে আসায় শ্রীঘরে ঠাই হলো ধর্ষক মামা এবং সহয়তাকারী মামি ও ইউপি সদস্য। মামিকে মা সাজিয়ে দায়ের করা ধর্ষণ মামলাটিও সাজানো হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে পুলিশি তদন্তে। এ ঘটনায় পুরো কক্সবাজার জুড়ে চলছে তোলপাড়।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের মুহুরীপাড়া গ্রামের মৃত কবির আহমদের ছেলে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভোজপুর হাজিরখিল হাজী আব্দুল ওয়াহাব জামে মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মোঃ ফরিদুল আলম। তার সাথে একই গ্রামের মৃত নজির আহমদের ছেলে নুরুন্নবীর জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে থানা আদালত ও ইউনিয়ন পরিষদে একাধিক মামলা রয়েছে। মৌলানা ফরিদকে ফাঁসাতে শেষ পর্যন্ত ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে নুরুন্নবী।
মৌলানা ফরিদ এর অভিযোগ, পেকুয়ার মগনামার ৫নম্বর ওয়ার্ড়ের ইউপি সদস্য আলমগীরের কু-পরামর্শে নানা ফন্দি তৈরি করতে থাকে নুরুন্নবী। শেষ পর্যন্ত নিজের বোনের শিশুকন্যাকে নিজে ধর্ষণ করে প্রতিপক্ষ মৌলানা ফরিদকে ফাঁসাতে তার বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় ৩ জুলাই একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করে। (কক্সবাজার সদর থানা মামলা নম্বর ৭, তারিখ ৩/৭/২০১৯)। ধর্ষণের শিকার শিশু কন্যার মা লতিফা বেগমের নাম ব্যবহার করে মামলার বাদী করা হয় ধর্ষকের স্ত্রী আমিনা বেগমকে।
সদর মডেল থানায় মামলাটি নথিভুক্ত করে তদন্তের ভার দেয়া হয় এসআই আবুল কালামকে। এরপর তিনি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তদন্ত শুরু করেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তা আবুল কালাম জানান, মামলা তদন্ত করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার শিশু কন্যার সাথে কথা বলে নানা প্রকার সন্দেহের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি আমি সাথে সাথে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন খন্দকারকে অবহিত করি। ওসির নির্দেশে তদন্তকালে প্রথমে যে ঘটনাস্থল দেখানো হয়েছে তার আশপাশে খবর নিয়ে দেখি কেউ এই ঘটনা সম্পর্কে অবহিত নয়। কক্সবাজার শহরের টেক পাড়ায় খোরশেদ আলমের বাড়িতে ঘটনাস্থল দেখানো হলেও তদন্তে দেখা যায় সেখানে কোনো ঘটনা হয়নি। এরমধ্যে জানতে পারি মামলার বাদী ধর্ষণের শিকার শিশু কন্যার মা নয় মামি। অথচ মা হিসেবে মামলা দায়ের করা হয়।।
তদন্তকারী কর্মকর্তা আবুল কালাম আরো বলেন, ১৬ জুলাই রাতে ধর্ষণের শিকার শিশু কন্যা, তার মা, ভাই বোন, মামা-মামি ও কয়েকজন প্রতিবেশীকে থানায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পরদিন সকালে ধর্ষণের শিকার শিশু কন্যা ও তার মাকে আদালতে জবানবন্দির জন্য পাঠিয়ে বাকিদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে আদালত তাদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, ধর্ষণের শিকার শিশু কন্যা আদালতে জবানবন্দিতে জানান, ৩ জুলাই রাতে ধর্ষণের শিকার শিশু তার নিজ মামা নুরুন্নবী, মামি আমিনা বেগমসহ কক্সবাজার শহরের জেলগেট এলাকায় অবস্থিত পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়ন এর ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আলমগীরের বাড়ীতে বেড়াতে যায়। রাত আড়াইটার দিকে মামি আমেনা বেগম প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘরের বাইরে গেলে, নিজ মামা নুরুন্নবী মুখ চেপে ধরে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে। মামা মামি তাকে শিখিয়ে দেয়, সে যেন পুলিশকে বলে মৌলানা ফরিদই তাকে ধর্ষণ করেছে।
ধর্ষণের শিকার শিশু কন্যাকে হাসপাতালে রেখে মামা নুরুন্নবী ও মামি আমিনা বেগম থানায় যায়। আমিনা বেগম নিজেকে লতিফা বেগম দাবি করে টিপ স্বাক্ষর দিয়ে মামলা দায়ের করে। তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, টিপসই এর নিচে মোবাইল নাম্বার দেওয়া হয় ইউপি সদস্য আলমগীরের।
ধর্ষণের শিকার শিশু কন্যা স্থানীয় একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাজী দিদারুল আলম জানান, স্কুলের বিভিন্ন অভিভাবক সমাবেশে ধর্ষণের শিকার শিশু কন্যার মা আসেন। স্কুলের সব কাগজপত্রে তিনি স্বাক্ষর করেন। অথচ সদর মডেল থানায় দায়েরকৃত ধর্ষণ মামলায় লতিফা বেগমের নাম দিয়ে আমেনা বেগম টিপসই দেন।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মো. খাইরুজ্জামান জানান, ১৯ জুলাই ধর্ষণের শিকার শিশু কন্যার মা লতিফা বেগম বাদী হয়ে নিজের ভাই নুরুন্নবী, ভাইয়ের স্ত্রী আমেনা বেগম ও তাদের নিজের এলাকার ইউপি সদস্য আলমগীরকে আসামি করে একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। পুলিশ সে মামলাটিও নথিভূক্ত করে উপ পরিদর্শক আবুল কালামকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়। পুলিশ পরদিন এই মামলার প্রধান আসামি ধর্ষক নুরুন্নবী, ভুয়া বাদী তার স্ত্রী আমিনা বেগমকে গ্রেফতার করে। পরদিন আটক করা হয় এই মামলার আরেক আসামি পেকুয়া উপজেলার মগনামার ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আলমগীরকে। তাদেরকে আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়।
তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ পরিদর্শক আবুল কালাম বলেন, প্রথম ঘটনাটি তদন্ত করতে গিয়ে বেশ কিছু বিষয়ে আমার সন্দেহ হয়। একমাত্র আসামি মৌলানা ফরিদ এর মোবাইল কল লিস্ট বের করে দেখা গেছে ঘটনার সময় তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি এলাকায় ছিলেন। তাছাড়া তিনি যে মসজিদে চাকরি করেন সে মসজিদের মতোয়াল্লীসহ কমিটির পক্ষ থেকে তিনি যে ঘটনার সময় তাদের মসজিদে ছিলেন তার একটি প্রত্যয়নও দেওয়া হয়।
কক্সবাজার সদর মডেল সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আদিবুল ইসলাম বলেন, প্রথম মামলা রুজু হওয়ার পর তদন্তকারী কর্মকর্তা কিছু বিষয় বুঝতে পেরে আমাকে অবহিত করেন। আমি তাকে বিষয়টি সূক্ষ্মভাবে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করি। একজন প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেই ভাগিনিতে মামার ধর্ষণের ঘটনাটি তদন্তকারী কর্মকর্তার বিচক্ষণতায় উৎঘাটন হয়েছে।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন খন্দকার বলেন, জমির বিরোধে একজন মসজিদের ইমামকে ফাঁসাতে এত বড় জঘন্য ঘটনা ঘটাতে পারে এটা প্রথমে ভাবতে পারিনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, ধর্ষণের শিকার শিশু কন্যার মা বাদী হয়ে মামলাটি করার পর তদন্তকারী কর্মকর্তাকে গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করতে বলি। এরকম একটি জঘন্য ঘটনা উদঘাটনের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে পুরস্কৃত করার জন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই জানানো হবে। যাতে অন্য তদন্তকারী কর্মকর্তারাও গুরুত্ব সহকারে তাদের উপর অর্পিত মামলার তদন্ত করেন। সে সাথে আসল অপরাধীরা কোনভাবে পার পাবে না বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।

পাঠকের মতামত: