ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

‘ইয়াবার রাজা’ সাইফুলের উত্থান-পতন

নিউজ ডেস্ক ::

ইয়াবা ‘রাজা’র মতোই দাপট ছিলো সাইফুল করিম ওরফে হাজী সাইফুলের। মাত্র এক যুগের ব্যবধানে সিআইপি শিল্পপতি সাইফুল শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর এই ফুলে-ফেঁপে ওঠা আলাদিনের চেরাগের নাম ইয়াবা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএসসি) ও গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় দেশের সবচেয়ে বড় ইয়াবার ডিলার এই সাইফুল করিম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাইফুল নিজেকে আমদানি-রফতানিকারক বলে পরিচয় দিতেন। তার বৈধ ব্যবসার সাইনবোর্ডের নাম এসকে ইন্টারন্যাশনাল। মিয়ানমারের মংডুর প্রস্তুতকারীদের কাছ থেকে দেশে সরাসরি ইয়াবার চালান নিয়ে আসা এবং চট্টগ্রামে নিয়ে পাচার করার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ছিলো সাইফুলের। তাঁকে আন্তর্জাতিক ইয়াবা কারবারিও বলা হয়। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও টাকার দাপটে বরাবরই ছিলেন আড়ালে। পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে সাইফুলের গভীর সখ্য ছিলো। তারাই তাকে শেল্টার দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সাইফুল টাকা দিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করে রাখতেন। নেপথ্যে থেকে লোক দিয়ে ইয়াবার কারবার করানোর কারণে তাঁকে ধরাও কঠিন ছিলো।
এসকে ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের নামে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার পরিচয়ে সিআইপি খেতাব পান সাইফুল। এই পরিচয়ের আড়ালে তাঁর মূল কারবার ইয়াবা। চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ির ভিআইপি টাওয়ারে রয়েছে তাঁর একাধিক অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট। এর কোনো একটিতে তাঁর বাস। রাজধানীতেও তাঁর একাধিক ফ্ল্যাট আছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকায় লাখ লাখ ইয়াবার চালান পৌঁছে দেয় তাঁর সহযোগীরা। বাসা বা হোটেলে বসে গোপন ফোন নম্বরে লেনদেন তদারকি করতেন সাইফুল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সাইফুলের গার্মেন্ট ও কাপড়ের পাইকারি ব্যবসা প্রসারিত হয়। চট্টগ্রামের টেরিবাজার ও রিয়াজউদ্দিন বাজারের দুটি আড়তেই রয়েছে তাঁর কয়েক শ কোটি টাকার কারবার।
জনশ্রুতি রয়েছে, মিয়ানমারের মংডুতে সাইফুল করিমের আলাদা সম্মান রয়েছে। মিয়ানামারের ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রকরা তাকে রাজার হালে অতিথি করে রাখতেন। কারণ প্রতি মাসে শুধুমাত্র সাইফুলের মাধ্যমে তাদের হাতে যেত ইয়াবা বিক্রির কোটি-কোটি টাকা।
আইনশৃংখলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি দেশব্যাপী মাদক বিরোধী অভিযান শুরু হলে তিনি গা ঢাকা দেন। আত্মগোপনের প্রায় ৯ মাস সাইফুল দুবাই ও মিয়ানমারে ছিলেন। গত শনিবার (২৫ মে) রাতে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি। এর পর তাকে গত রবিবার সড়কপথে কক্সবাজার নিয়ে আসা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বর্শেষ ১৪১ জন শীর্ষ মাদক কারবারির একটি তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দেয় ডিএনসি। এর বাইরে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ১১০ জন মাদক কারবারির তালিকা সংগ্রহ করেছে দুদক। সবগুলো তালিকায় শীর্ষে রয়েছে হাজী সাইফুলের নাম। ডিএনসির চট্টগ্রাম অঞ্চলের তালিকায় ১ নম্বরে রয়েছে তাঁর নাম। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের শিলবনিয়াপাড়া গ্রামের ডা. হানিফের ছেলে এই সাইফুল।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সাইফুল করিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশে প্রথম ইয়াবার চালান আনা হয়। ২০০৬ সাল থেকে ইয়াবা কারবারে জড়িত সাইফুল। ছাত্রজীবনে ছাত্রদল করতেন। বিয়ে করেন টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহর বোনকে। সরকার বদল হলেও তাঁর মাদক কারবার কখনো বাধাগ্রস্ত হয়নি। বরং বেড়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দলীয়ভাবে নিষ্ক্রিয় থেকে ভোল পাল্টে নেন সাইফুল। স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা কারো চোখ এড়ায়নি। মিয়ানমারের মংডুর বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা সিন্ডিকেটের সঙ্গে রয়েছে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। যারা কিচেন ল্যাব বা বাসার কারখানায় ইয়াবা তৈরি করে তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে সরাসরি নিয়ে আসে সাইফুলের লোকজন। এর জন্য ঘাটে ঘাটে ঠিক করা আছে তাঁর লোক। নির্বিঘেœ ইয়াবার কারবার চালাতে প্রশাসনকেও টাকা দেন সাইফুল। শুরুতে টেকনাফ ও কক্সবাজারে থেকে কারবার পরিচালনা করলেও ২০১১ সালের পর চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ইয়াবার কারবার শুরু করেন সাইফুল।
গত বছরের ৪ এপ্রিল চট্টগ্রামের হালিশহরে এক চালানে ১৩ লাখ ইয়াবা বড়ি আটক হওয়ার পর কক্সবাজার ও মিয়ানমারের মূল চোরাকারবারিদের নাম বেরিয়ে আসে। তাঁদের একজন সাইফুল করিম। ১৩ লাখ ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত দুই আসামি রশিদ ওরফে মুন্না ও আশরাফ আলী চট্টগ্রামের আদালতে সাইফুল করিম এবং মিয়ানমারের চোরাকারবারি আবদুর রহিমকে জড়িয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাতে ১৮ কোটি টাকা লেনদেনের বিষয়টি উঠে আসে।
হঠাৎ দেশে ফেরা ঃ গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম দফায় ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করার পর সাইফুল নিজেই আত্মসমর্পণের জন্য যোগাযোগ করেন। পরে এ প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারী একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সবুজ সংকেত পান তিনি। এর পরই বিমান বাংলাদেশের একটি ফ্লাইটে শনিবার রাত ১১টার দিকে ঢাকায় আসেন সাইফুল। পরে ১১টা ২০ মিনিটে একটি গাড়িতে করে তিনি বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। পরে আত্মসমর্পন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সাইফুলকে ‘পুলিশের সেফ হোমে’ রাখা হয়েছে  বলে খবর রটে যায়।
সূত্রমতে, সাইফুলের হঠাৎ এই দেশের ফেরার পেছনে আপন দুই ভাই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টিও কিছুটা ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে। গত ৩ মে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন সাইফুলের দুই ভাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী রাশেদুল করিম ও মাহাবুবুল করিম। তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক বাড়ি থেকে ১০ হাজার ইয়াবা এবং চারটি দেশীয় বন্দুক ও ১০ রাউন্ড গুলি উদ্ধারের কথা জানায় পুলিশ। পরে তাদের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তারা বর্তমানে কারাগারে বন্দী রয়েছেন। এ ঘটনার পরই সাইফুল হয়তো দেশে ফেরার বিষয়ে আগ্রহী হয়েছেন।
বন্দুকযুদ্ধে ‘ইয়াবা রাজার’ মৃত্যু ঃ টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ জানান, দীর্ঘ ৯ মাস আত্মগোপনের পর কয়েক দিন আগে সাইফুল করিম বিদেশ থেকে টেকনাফ আসেন। এ সময় পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল জানান, কয়েক দিন আগে মিয়ানমার থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইয়াবার বড় একটি চালান এনেছেন। সেই চালান টেকনাফ স্থলবন্দরের সীমানা প্রাচীরের শেষ প্রান্তে নাফ নদীর পাড়ে মজুত করেছেন। সাইফুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে ইয়াবা উদ্ধারের জন্য তাঁকে নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলে অস্ত্রধারী ইয়াবা ব্যবসায়ীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকেন। এ সময় অস্ত্রধারীদের গুলিতে টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাসেল আহমেদ, কনস্টেবল ইমাম হোসেন ও মো. সোলাইমান আহত হন। এরপর আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়ে। গোলাগুলিতে সাইফুল করিম গুলিবিদ্ধ হন। একপর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে মাদক ব্যবসায়ীরা গুলি করতে করতে পাশের জঙ্গলে আত্মগোপন করেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ সাইফুল করিমকে উদ্ধার করে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখানে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক প্রণয় রুদ্র বলেন, গুলিবিদ্ধ সাইফুল করিমকে দিবাগত রাত দেড়টার দিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। তাঁর শরীরে চারটি গুলির দাগ ছিল। একটি বুকে ও তিনটি পেটে।
ওসি প্রদীপ কুমার দাশ আরও জানিয়েছেন, বন্দুকযুদ্ধের পর ঘটনাস্থল থেকে ১ লাখ ইয়াবা বড়ি, ৯টি আগ্নেয়াস্ত্র (এলজি), শর্টগানের ৪২টি তাজা কার্তুজ ও ৩৩টি কার্তুজের খোসা জব্দ করা হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধে পুলিশের একজন এসআই ও দুজন কনস্টেবল আহত হয়েছেন।

পাঠকের মতামত: