ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

কক্সবাজারের ইয়াবা বাজার বেসামাল

অনলাইন ডেস্ক ::   কক্সবাজারে ইয়াবা পাচার, বিক্রি ও সেবনের কৌশল পাল্টে গেছে। কারবারিরা এবার পথ ধরেছে ফেরি করেই ইয়াবা বিক্রির। গভীর রাতেও ফেরি করে বিক্রি চলছে। ফেরিওয়ালারা ডাক দিয়ে বলছে- ‘ইয়াবা খাইলে আইয়্যু আইয়্যু, খোলা বিক্রি দেড়শ টাকা, ঘরে খাইলে দুইশ টাকা।’ এমন রসালো ডাকে ফেরিওয়ালারা প্রলুব্ধ করছে ইয়াবা সেবনে। ইয়াবার এরকম একটি হাটের রমরমা আসরে শনিবার মধ্যরাতের পর পুলিশ হানা দিয়ে সরঞ্জামাদি সহ আটক করেছে ২ জন বিক্রেতাকে। অন্যান্যরা এসময় পালিয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ সহ ইয়াবা বিরোধী অভিযানে নিয়োজিত অন্যান্য আইন শৃংখলারক্ষাকারি সংস্থার সদস্যরা অবিরাম চেষ্টা করেও সামাল দিতে পারছে না।
কক্সবাজার শহরতলির সদর উপজেলা পরিষদ ভবন সংলগ্ন পাড়ার ইয়াবা হাটে শনিবার মধ্যরাতে নারী-পুরুষ ফেরিওয়ালার দল হাঁক-ডাক দিয়েই বিক্রি করছিলেন খুচরা ইয়াবা। পাড়ার একজন বাসিন্দা হচ্ছেন সংবাদকর্মী। ওই সংবাদকর্মী মধ্যরাতে শহরতলির ঘরে ফিরার সময় ইয়াবা বিক্রি ও সেবনের হাটটিতে মারমারির দৃশ্য দেখে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে আসার আগেই মহল্লার বাসিন্দারা সেলিম নামের একজনের ঘর ঘিরে ফেলে। এ সময় ঘরের বাসিন্দা সেলিম ওরফে রোহিঙ্গা সেলিম ইয়াবা ও সেবনের সরঞ্জামাদি নিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।
ইয়াবা বিক্রেতা সেলিম তাড়াহুড়ো করে ঘরের দরজা তালা দেয়ার কারনে তালাবদ্ধ ঘরে আটকা পড়ে যায় তার সন্তান ফয়সল (১৮)। পুলিশ ঘরের তালা ভেঙ্গে আটক করে সন্তান ফয়সলকে। এরপর পুলিশের দল পার্শ্ববর্তী মাহমুদা বেগম নামের এক ইয়াবা সুন্দরির ঘরে হানা দেয়। মাহমুদা এর আগেই গা ঢাকা দেয়। পুলিশ মাহমুদার ঘর তল্লাশী করে উদ্ধার করে বিপুল পরিমাণের ইয়াবা বড়ির খালি প্যাকেট, ইয়াবা সেবনের সরঞ্জামাদি ও ২ টি ডেগার।
অভিযানে আটক ফয়সাল পুলিশের কাছে স্বীকার করে ঝিলংজার দক্ষিণ হাজী পাড়ার ইয়াবা সুন্দরী পলাতক মাহমুদার ইয়াবা ব্যবসা দেখাশুনা করে তারই ইয়াবা পুত্র আব্বাস, কন্যা ইয়াসমিন ও হাজী পাড়ার সুলতানের পুত্র লিটন। গতকাল লিটন ও আব্বাসের নেতৃত্বে ইয়াবার একটি বড় চালান দক্ষিণ হাজী পাড়ার গ্রামে মাহমুদার বাড়ীতে আসে। এ সময় আরেক সন্ত্রাসী রবি উল্লাহ ইয়াবার ভাগ দাবি করে। এ নিয়ে আব্বাস ও ফয়সালের সাথে রবির প্রথমে হাতাহাতি ও পরে একে অপরকে ঘায়েল করতে হাতে ছোরা নেয়। এ নিয়ে এলাকায় এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে রাতে সেখানেই পুলিশের দলটি অভিযান পরিচালনা করে।
ইয়াবা বিক্রেতা মাহমুদার স্বামী কবির আহমদ কক্সবাজার শহরের একটি বহুতল ভবনের নাইট গার্ড। স্বামীকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েই মাহমুদা তার ছেলে আব্বাস ও কন্যা ইয়াসমিনকে সাথে নিয়ে মহল্লায় ইয়াবার রমরমা হাট বসিয়েছে। পাড়ার বাসিন্দা এবং স্থানীয় সংবাদকর্মী মাহবুবর রহমান জানান, ইয়াবা রাণী হিসাবে পরিচিত মাহমুদা বেগম তার ছেলে ও কন্যা সহ পাড়ার আরো বেশ কিছু ছেলে-মেয়ে দিয়ে ইয়াবার হাটটি চালিয়ে আসছে। মাহমুদার কন্যা ইয়াসমিন রোহিঙ্গা শিবিরে একটি বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) চাকুরি করে। এমন সুযোগে রোহিঙ্গা শিবির থেকেই ইয়াসমিন ইয়াবার চালান নিয়ে আসে নিজ ঘরে।
পুলিশ একই অভিযানে আটক করে রহিমুদ্দিন নামের একজন রোহিঙ্গাকেও। রহিমুদ্দিনের স্ত্রী শাহানা বেগমও একজন ইয়াবা বিক্রেতা। গত ৭ মাস আগে কক্সবাজার সদর থানা পুলিশের হাতে ৩৫০ টি ইয়াবা নিয়ে আটক হয় শাহানা বেগম। শাহানা বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। গতকাল রবিবার দুপুরে কক্সবাজার থানা হাজতে পুলিশের সামনে রহিমুদ্দিন জানান-‘আমার স্ত্রী এবং আমি দীর্ঘদিন ধরেই কারবারে জড়িত রয়েছি। আমার স্ত্রী এ পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় ইয়াবা ফেরি করে বিক্রি করার কাজে জড়িত। এরকম বিক্রি কারেই ধরা পড়ে পুলিশের হাতে।’
পুলিশের হাতে আটক ইয়াবা বিক্রেতা রহিমুদ্দিন আরো জানান, প্রতি পিচ ইয়াবা বড়ি তারা পাইকারি বাজার থেকে ৬০/৭০ টাকায় কিনে আনেন। এরপর মহল্লায় মহল্লায় খুচরা হিসাবে দেড়শ-দুশ টাকায় বিক্রি করে। পলাতক ইয়াবা সুন্দরী মাহমুদার স্বামী ও সন্ত্রাসী আব্বাসের পিতা নাইট গার্ড কবির আহমদ জানান- আমি ধ্বংস হয়ে গেছি আমার পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। স্ত্রী মাহমুদা দীর্ঘদিন ধরে ইয়ারার বড় বড় চালান পাচারে জড়িত। চট্টগ্রামে দুইবার ধরা খেয়েছে, জেলও খেটেছে। দুইটি মামলার মাহমুদা এখন পলাতক। আমার ছেলে আব্বাস ও ইয়াসমিন এখন ইয়াবার পাইকার ও খুচরা ডিলার। প্রতিবাদ করায় মা, মেয়ে ও ছেলে মিলে আমাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
দক্ষিণ হাজী পাড়া গ্রামে জামে মসজিদ ও সমাজ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাজী সৈয়দ নূর জানান দীর্ঘদিন ধরে চক্রটি কক্সবাজার সদর উপজেলা কম্পাউন্ডের পরিত্যাক্ত দুইটি ভবন, ঝিলংজা খাদ্য গুদামের পরিত্যাক্ত ভবন, আব্বাস, চায়না ড্রাইভার, ফয়সাল তাদের বাড়ীতে জমজমাট ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় কেউ প্রতিবাদ করলে অবৈধ অস্ত্র ও ছোরা নিয়ে হত্যার হুমকি দেয়। যার কারণে কেউ চিহ্নিত এই ইয়াবা কারবারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ও সাহস করে না। কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও স্থানীয় বাসিন্দা মমতাজ উদ্দিন বাহারী জানান- উপজেলার নাইট গার্ড মনজুর ও খাদ্য গুদামের কিছু অসাধু কমর্কর্তা-কর্মচারীর আস্কারায় ইয়াবা কারবারিরা ফেরি করে, প্রকাশ্যে- গোপনে ইয়াবার পাইকার ও খুচরা বিক্রি এবং সেবন সেবাদানের জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ইয়াবা বিরোধী অভিযানে নেতৃত্বদানকারী কক্সবাজার মডেল থানা পুলিশের এসআই সুজন মজুদার জানান- দক্ষিণ হাজী পাড়া গ্রামে অভিযানে না আসলে বুঝতে পারতাম না ইয়াবা কত গভীরে চলে গেছে। ইয়াবা বেচা-বিক্রি ও সেবনকারী কেউ রেহাই পাবে না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
অভিযান পরিচালনাকারি কক্সবাজার সদর মডেল থানার উপ পরিদর্শক সুজন মুজমদার বলেন-‘টেকনাফ-উখিয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এখন ইয়াবার রমরমা হাট কক্সবাজার শহর ও শহরতলিতে জেঁকে বসেছে। আমি যখন শনিবার রাতে খবর পেয়ে থানা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দুরের সদর উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন পাড়ার ঘটনাস্থলে রওয়ানা দিই ততক্ষণে আরো দু’টি স্থানের ইয়াবা হাটের নানা ঘটনার খবর পেয়ে যাই। এ কারনে নির্দ্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে আমার যথেষ্ট বিলম্ব হয়।’ পুলিশের উপ পরিদর্শক কক্সবাজার শহরতলির ইয়াবা হাটের বিস্তৃতির উদ্বেগজনক একটি চিত্রের বিবরণ জানাচ্ছিলেন এভাবেই।
এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ উদ্দিন খোন্দকার জানান, ইয়াবার বিস্তার এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে রিতীমত হিমসিম খেতে হচ্ছে পুলিশকে। সদর থানাটিতে বর্তমানে ৫০ জনেরও অধিক পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন। এসব কর্মকর্তাদের সবচেয়ে বেশী সময় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে ইয়াবা সংক্রান্ত অপরাধ কর্মকান্ডে। তিনি বলেন, ইয়াবা যেখানেই সেখানেই পুলিশ গিয়ে তাৎক্ষনিক অভিযান চালিয়ে আসছে। কিন্তু তারপরেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।

পাঠকের মতামত: