ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

বন বিভাগের ‘মেহেদী সিন্ডিকেটে’র প্রধানসহ তিনজন সাসপেন্ড  

মহসীন শেখ, কক্সবাজার ::   
চলতি অর্থ বছরে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের রাজস্ব খাতের প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বহুল বিতর্কিত ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা সদর রেঞ্জে’র দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটে। তার সাথে অফিস সহকারি, হিসাবরক্ষক আবুল কালাম ও ফরেস্ট গার্ড মোকাদ্দেসসহ একটি সিন্ডিকেট এসব সরকারি টাকা আত্মসাৎ করে। এ ঘটনা জানাজানি হলে প্রথমে তা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলে। পরে ঘটনা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে গেলে সিন্ডিকেটের প্রধান মেহেদী হাসান, অফিস সহকারি ও হিসাব রক্ষকের পরামর্শে এবং চাপে অফিসস্থল ত্যাগ করে আত্মগোপনে চলে যান ওই বিভাগে কর্মরত ফরেস্ট গার্ড মোকাদ্দেস। ঘটনা নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেলে গত মার্চের শুরুতে তা তদন্তে আসেন চট্রগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. জগলুল হোসেন। তিনি তদন্তে সরকারি টাকা আত্মসাতের প্রমান পান। পরে ঘটনায় জড়িত চারজনকে বরখাস্ত ও আত্মসাতকৃত টাকা আদায়ের সুপারিশ করে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ। এদিকে আত্মসাতকৃত টাকা জমা দিয়ে শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ঢাকায় তদবির করছেন ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা। তবে এ ঘটনায় সদর রেঞ্জে’র দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেহেদী হাসান, হিসাবরক্ষক আবুল কালাম ও ফরেস্ট গার্ড মোকাদ্দেসকে ইতিমধ্যেই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এরপরও থেমে নেই দুর্নীতিবাজরা। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পুরো ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগের একটি সূত্র। এ ঘটনায় বন বিভাগে তোলপাড় চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, চলতি মাসে সরকারি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়ার পর তা প্রথমে কক্সবাজার কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালান। কিন্তু কক্সবাজার কার্যালয়ের উধ্বর্তন কর্মকর্তারা এর ঝুঁকি না নেওয়ায় হিসাবরক্ষক আবুল কালাম সিন্ডিকেট প্রধান সদর রেঞ্জে’র দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেহেদী হাসানের পরামর্শে ফরেস্ট গার্ড মোকাদ্দেসকে নিরুদ্দেশ হতে পরামর্শ দেন। পরে মোকাদ্দেস কাউকে কিছু না বলেই কর্মস্থল ত্যাগ করেন। এমনকি বেশ কয়েকদিন তার মোবাইল ফোনও বন্ধ রাখেন। খোঁজ পাওয়া যায়নি তার বাড়িতেও। এ অবস্থায় ঘটনা তদন্তে কক্সবাজার আসেন চট্রগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. জগলুল হোসেন। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাপে টাকা আত্মসাৎকারী সিন্ডিকেটটি কয়েকদিন পর মোকাদ্দেসকে হাজির করেন। মোকাদ্দেসের স্ত্রীসহ স্বজনরাও হাজির হন। পরে মোকাদ্দেস ঘটনা খুলে বলেন। টাকা আত্মসাতকারি সিন্ডিকেটটি মোকাদ্দেসকে ফাঁসিয়ে দিয়ে ঘটনা সেখানেই ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা চালান। কিন্তু চট্রগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. জগলুল হোসেন ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় ঘটনায় জড়িত চারজনকে বরখাস্ত ও আত্মসাতকৃত টাকা আদায়ের সুপারিশ করে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ।
সূত্রটি আরও জানায়, সিন্ডিকেট প্রধান সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা মেহেদী হাসান, অফিস সহকারি এবং হিসাবরক্ষক আবুল কালাম গত কয়েক বছরে ৫/৬ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দেশের বাড়ি ও কক্সবাজারে তারা গাড়ি, জমিসহ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করেছেন। ২/৩ বছর ধরে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ কার্যত মেহেদী হাসানের হাতেই জিম্মি ছিল। উত্তর বন বিভাগের বিশেষ টহল দলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পাশাপাশি সদর রেঞ্জ কর্মকর্তার মতো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব ছিল মেহেদী হাসানের উপর। অপরদিকে অফিসের দাপ্তরিক কাজ এবং হিসাব খাতও ছিল তার নিয়ন্ত্রনে। গত এক বছর ধরে তার হয়ে আবুল কালাম তা নিয়ন্ত্রন করছেন। ওই শক্তিশালী সিন্ডিকেটটি প্রায় তিন বছর জিম্মি করে রাখে উত্তর বন বিভাগ। এই সুযোগে গত ২/৩ বছরে পাহাড় কাটা, বনের জমির দখল বিক্রি, গাছ বিক্রি, পাহাড়ের মাটি ও গাছ পাচারের গাড়ি জব্দ করে টাকা আদায়, মোটা অঙ্কের জরিমানা আদায় করে নামেমাত্র জরিমানা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে সিংহভাগ টাকা আত্মসাৎ, ভুয়া চালান তৈরী, রাজস্ব ও বিভিন্ন প্রকল্পের হিসাবে বিভিন্ন জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে এই মেহেদী হাসান সিন্ডিকেট। তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আসলে তাও ধামাচাপা পড়ে যেতো। এমনকি ক্ষমতার দম্ভে নিজ দপ্তরের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাদেরও তিনি পাত্তা দিতেন না। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিনিয়র এক রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, ‘মেহেদী হাসান চাকরিতে বলতে গেলে নবীন। কিন্তু অল্প সময়েই সে বিশেষ টহল দল ও সদর রেঞ্জে’র মতো গুরুত্বপূর্ণ দু’টি দপ্তরের দায়িত্ব একসাথে পালন করার সুযোগ পান। যার কারণে সে কোন কিছুই তোয়াক্কা করতো না। অল্পতে বেশি পেলে যা হয় তাই হয়েছে তার সাথে।’  মেহেদী হাসানের এসব বিষয় এখন বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে মুখে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এ বিষয়ে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফরেস্ট গার্ড মোকাদ্দেসের সাথে যোগাযোগের জন্য তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অপরদিকে যোগাযোগ করা হলে উত্তর বন বিভাগের হিসাবরক্ষক আবুল কালাম দাবী করেন তিনি এসব অনিয়ম ও টাকা আত্মসাতের সাথে জড়িত নন। অভিযুক্ত সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা মেহেদী হাসানও একইভাবে তিনি জড়িত নন বলে দাবী করেন।
জানতে চাইলে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের সহকারি বন সংরক্ষক বেলায়েত হোসেন ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হক মাহবুব মোর্শেদ সরকারি টাকা আত্মসাতের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, তারা টাকা জমা দিয়েছেন। এছাড়া জড়িতদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। #####

পাঠকের মতামত: