ঢাকা,শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কক্সবাজার থেকে চিংড়ি পোনা পরিবহন করছে মুড়ির টিন মার্কা কার্গো বিমান !

Newqs Pic (2)আতিকুর রহমান মানিক, কক্সবাজার :::
কক্সবাজার থেকে চিংড়ি পোনা পরিবহনকারী অভ্যন্তরীণ কার্গো উড়োজাহাজ বহর আকাশপথে মারাত্নক ঝুঁকি নিয়ে চলছে। সিভিল এভিয়েশনের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মুনাফালোভী চিংড়ি পোনা ব্যবসায়ীদের  শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেটের সহায়তায় লক্কর-ঝক্কর ও মুড়ির টিন মার্কা মেয়াদোত্তীর্ণ বিমান নিয়ে এ রুটে ব্যবসা চালাচ্ছে কয়েকটি বিমান সংস্থা। এদের প্রায় বিমানই লক্কর-ঝক্কর মার্কা ও ৩০-৩৫ বছরের পুরনো। এমনকি ৩০ বছর আগে  বাংলাদেশ বিমানবাহিনী থেকে বাতিল করা বিভিন্ন মডেলের উড়োজাহাজও এ রুটে চলছে বছরের পর বছর ধরে। বিভিন্ন দেশের মেরামত হ্যাঙ্গারে পড়ে থাকা চলাচলের অযোগ্য এসব এয়ারক্রাফট আমদানি করে সিভিল এভিয়েশনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহায়তায় চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে কক্সবাজার-ঢাকা-সাতক্ষীরা কেন্দ্রীক একটি সিন্ডিকেট। মোটা অংকের ঘুষে বশীভুত হয়ে
সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ উড়োজাহাজগুলো আকাশে ওড়ার অনুমতি দিচ্ছে বলে জানা গেছে। শুক্রবার সকালে সরেজমিন কক্সবাজার বিমান বন্দরে গিয়ে দেখা যায়, টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের দক্ষিন দিকে মূল রানওয়ের বাইরে ল্যান্ড করা রয়েছে জরাজীর্ন কয়েকটি কার্গোবিমান। এসব বিমান সার্বক্ষনিক টুকটাক মেরামতে ব্যস্ত আছেন কয়েকজন কর্মী। মুড়ির টিন মার্কা এসব কার্গো বিমানে চিংড়ি পোনা পরিবহন করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে একটি বিমান দীর্ঘদিন ধরে আকাশে উড়েনা বলে জানা গেছে। হ্যাচারী মালিক ও পোনা ব্যবসায়ীরা জানান, পোনা পরিবহনে পুরনো লক্কর ঝক্কর বিমান ব্যবহার করা হলেও মোটা অংকের গলাকাটা চার্জ নেয়া হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। কক্সবাজার- যশোর সংক্ষিপ্ত আকাশপথে প্রতিবক্স পোনা পরিবহনে একহাজার টাকারও বেশী চার্জ নিচ্ছে কার্গোবিমান সংস্হাগুলো। এতে প্রতি পোনার পরিবহন ব্যয় দাড়াচ্ছে দশ পয়সারও বেশী, অথচ বিভিন্ন সময় পোনার দাম থাকে পনের থেকে বিশ পয়সার মধ্যে। এভাবে ওভারচার্জ করার পরেও বোঝাই করা হচ্ছে ধারন ক্ষমতার অতিরিক্ত পণ্য। এভাবে লাভজনক হওয়ায় চিংড়ি পোনা পরিবহনে পুরনো কার্গো বিমানের ব্যবহার বেড়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ডেসটিনি গ্রুপের মালিকানাধীন একটি এয়ারক্রাফটের কমপক্ষে ২৬টি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সরেজমিন পরিদর্শন করে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) দিয়েছিল খোদ সিভিল এভিয়েশনের একটি টিম। পরবর্তী সময়ে ওই ঘটনা ফাঁস হলে ওই এয়ারলাইন্সের এওসি (এয়ার ওয়ার্দিনেস সার্টিফিকেট) বাতিল করা হয়। বুধবার সকালে কক্সবাজার সংলগ্ন সাগরে যে এয়ারক্রাফটি (এএন-২৬) বিধ্বস্ত হয় তারও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সুত্র জানায়, উড়োজাহাজটির একটি ইঞ্জিন  বছরের অধিকাংশ সময় নষ্ট থাকত। ট্রু এভিয়েশনের মালিক রাশিয়ায় বসবাসরত তুষার নামে এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। তার বড় ভাই রাজ বাংলাদেশে এটি পরিচালনা করতেন। সফিউল আজম নামে সিভিল এভিয়েশনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা উড়োজাহাজটির দেখাশোনা করতেন। কিন্তু সিভিল এভিয়েশনের ওয়েবসাইটে এয়ারলাইন্স তালিকায় ট্রু এভিয়েশনের নাম নেই। বিধ্বস্ত হওয়া উড়োজাহাজটি কক্সবাজার-যশোর রুটে চিংড়ি পোনা বহন করত।
জানা গেছে, ট্রু এভিয়েশনের পরিচালনায়  একই মডেলের দুটি পুরনো এয়ারক্রাফট রয়েছে। এদের মধ্যে একটির পার্টস ও যন্ত্র নষ্ট হলে দ্বিতীয়টি থেকে ওই যন্ত্রটি খুলে লাগানো হতো। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এটি মারাত্মক অপরাধ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব যন্ত্রাংশ স্থানান্তরের সময় সিভিল এভিয়েশনকে জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও মালিকপক্ষ তা করত না।
সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, উড়োজাহাজটির পাওয়ারকাট- পিসিটিও (ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার যন্ত্র) প্রায়ই বিকল থাকত। ফলে কর্তৃপক্ষ মানুষ ভাড়া করে ধাক্কা দিয়ে ইঞ্জিন চালু করত। নাম না প্রকাশের শর্তে একজন পাইলট জানান, ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় দেশীয় কোনো পাইলট ট্রু এভিয়েশনের ফ্লাইট চালাতেন না। এ কারণে বিদেশী পাইলট ভাড়া করে ফ্লাইট চালানো হতো। এর মধ্যে
লাভের একটি অংশও পেতেন বিদেশী পাইলটরা। মাঝে মধ্যে বিদেশী পাইলটও ফ্লাইট চালাতে অপারগতা প্রকাশ করতেন। এ জন্য বেতনের বাইরে প্রত্যেক পাইলট ফ্লাইটপ্রতি ২শ’ ডলার ও ফার্স্ট অফিসার ১শ’ ডলার করে কমিশন পেতেন।
জানা গেছে, এএন-২৬ মডেলের ওই উড়োজাহাজটি বেশ কিছুদিন আগে থেকে মেয়াদহীন এক্সচুয়েটর ফুয়েল কক নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। কিন্তু সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ সেটি কখনও আমলে নিত না। এ ছাড়া এয়ারক্রাফটের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র সুইচ টেম্পারেচারটিও প্রায়ই নষ্ট থাকত।
এ ছাড়া এয়ারক্রাফটের ৪টি প্রধান ব্যাটারির মেয়াদ ছয় মাস আগেই উত্তীর্ণ হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। লেফট ও রাইট হ্যান্ড ইঞ্জিন ফায়ার কার্টিজের অবস্থাও ছিল লক্কর-ঝক্কর। একই অবস্থা ছিল এয়ারক্রাফটের ৪টি ফায়ার এক্স ইঞ্জিন কার্টিজেরও। এ ছাড়া এফডিআর রাইট ডাটা রেকর্ডার যন্ত্রটির মেয়াদও ছিল না। এয়ারক্রাফটির ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং গিয়ার ও ডাউন সিলেকশন বাল্বের অবস্থাও ছিল শোচনীয়।
এ ছাড়া লেফট ইঞ্জিন মাউন্ট ও রাইট ইঞ্জিন মাউন্ট (যেখানে ইঞ্জিন দুটি ঝোলানো হয়) সেটিও দীর্ঘদিন নষ্ট অবস্থায় ছিল। উড়োজাহাজটির এক্সচুয়েটর ডব্লিউ কক (বাম ও ডান) যন্ত্র দুটিও মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। আকাশে বৃষ্টির মধ্যে ফ্লাইট চললে উড়োজাহাজের মধ্যে পানি ঢুকত। পরে যন্ত্রপাতি খুলে রানওয়েতে শুকানো হতো। উড়োজাহাজটি ল্যান্ড করার পর জাহাজ থেকে মবিল পড়ে রানওয়ে নষ্ট হয়ে যেত। ফলে মালিকপক্ষ ফ্লাইট ল্যান্ড করার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনের নিচে বড় আকারের ড্রাম বসিয়ে রাখত।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিবছর একবার করে উড়োজাহাজের লাইফ কম্পোনেন্টগুলোর পরিদর্শন করতে হয়। তা না থাকলে যে কোনো এয়ারক্রাফটের এয়ারওর্দিনেস সার্টিফিকেট (এওসি) বাতিল করে দিতে পারে। কিন্তু অভিযোগ আছে, রাজ নামে ওই ব্যক্তি প্রতিমাসে সিভিল এভিয়েশনের একটি সিন্ডিকেটকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিতেন।
এদিকে দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে সিভিল এভিয়েশনের একটি সূত্র জানায়, ফ্লাইটটি আকাশে ওঠার কিছুক্ষণ পরই লেফট ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে। বিষয়টি পাইলট তিনি তাৎক্ষণিক বিমানবন্দরকে জানান। বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটটিকে আবারও অবতরণের জন্য বলা হলে পাইলট নিচে নেমে আসেন। কিন্তু যন্ত্র বিকল থাকায় পাইলট রানওয়ে দেখতে পাননি। তিনি ফ্লাইটটিকে অবতরণ করার একপর্যায়ে দেখতে পান, যেখানে নামছেন সেখানে কোনো রানওয়ে নেই। এরপর দ্রুত উপরে উঠতে গিয়ে অতিরিক্ত চাপে দ্বিতীয় ইঞ্জিনটিও বিকল হয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি) উইং কমান্ডার জিয়া-উল কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ ঘটনায় একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। টিমের প্রধান সিভিল এভিয়েশনের মেম্বার (অপারেশন) এয়ার কমোডর এম মোস্তাফিজুর রহমান।
সদস্যরা হলেন, এফওআই শাখার সিনিয়র কনসালটেন্ট ক্যাপ্টেন ফরিদ উজ জামান, ডেপুটি পরিচালক সাইফুল হক শাহ ও ডা. লে. কর্নেল (অব.) আবদুল খালেক। দু-এক দিনের মধ্যে তারা একটি প্রাথমিক রিপোর্ট দেবেন। তিনি বলেন, রেগুলেশনের বাইরে গিয়ে এয়ারক্রাফটি পরিচালিত হয়েছিল কিনা সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জিয়া-উল কবির আরো বলেন, এয়ারক্রাফটের কোন যন্ত্রাংশের মেয়াদ কখন শেষ হবে এবং সেটি কতদিন ব্যবহার করা যাবে তা উৎপাদনকারী কোম্পানির ম্যানুয়ালে বলা থাকে। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ম্যানুয়েল অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। যদি কোনো সুবিধা দিয়েও থাকে তাহলে সেটি রেগুলেশনের মধ্যেই বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য, বেসরকারি বিমান সংস্থা টু এভিয়েশনের কার্গো বিমানটি চিংড়ি পোনা নিয়ে কক্সবাজার থেকে যশোর যাওয়ার সময় বুধবার বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার নাজিরারটেক পয়েন্টে বিধ্বস্ত হয়। এতে বিমানের পাইলটসহ ৩ ইউক্রেনিয়ান নাগরিক নিহত হয়।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন বিমানের পাইলট মুরাদ (৩৮), কো-পাইলট প্যাট্রট ইভান (৩৭) ও ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার গুফারেড (৪০)।এ ঘটনায় বিমানের ফ্লাইট নেভিগেটর ডলোডায়মার (৪১) আহত হন।পরে বুধবার রাতেই কক্সবাজার সদর হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। তার অবস্হা বর্তমানে শঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

পাঠকের মতামত: