ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

সড়কে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ডাম্পার!

শাহীন মাহমুদ রাসেলঃ ডাম্পার এখন সড়কে কিংবা মহাসড়কে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। যে ঘাতক সড়কে চলতে গিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে না। এ ডাম্পারের অধিকাংশ চালকই অদক্ষ ও আনাড়ি প্রকৃতির। এরা প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ঘটাচ্ছে দুর্ঘটনা। এতে যাত্রীরা হয় নিহত হচ্ছে অথবা আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে। সর্বশেষ গত মাসে এই ঘাতক ডাম্পার রামু জোয়ারিয়ানালা এলাকায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ঘটনাস্থলেই ২ জনকে হত্যা করে।

গুরুতর আহত অপর দুজনের মধ্যে জাহাঙ্গীর নামে আরেকজন কিছুদিন আগে মারা যায়। মানুষ হত্যা আর পঙ্গু করছে যে ঘাতক সেই ঘাতককে কে রুখবে? এই প্রশ্ন দুর্ঘটনার শিকার নিহতদের পরিবারগুলোর। নিহত খুরশেদের ছেলে জনি জানান, ইচ্ছে করলে পুলিশ সুপার সাহেব এই দানবকে এক দিনে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন।

গত কিছুদিন আগে দুর্ঘটনার পর সরজমিনে গেলে দেখা যায়, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের ভেতরে ও গোল ঘরের সামনে একই ভ্যান গাড়িতে রয়েছে পর পর দুটি তরতাজা লাশ। যার মধ্যে একটি লাশ ঈদগড়ের এলাকার জমাদ্দার বাড়ির মৃত নোয়াব আলীর ছেলে সিএনজি চালক সুমন (৩০) ও আরেকজন রামু জাদিমুরা এলাকার মৃত প্রকাশ পালের ছেলে বিল্পব পাল (৩৫)। যারা সবেমাত্র জীবন্ত মানুষ থেকে লাশে রূপান্তরিত হয়েছে।

এই রূপান্তরেরর জন্য একমাত্র দায়ী এই অবৈধ ডাম্পার। তরতাজা এই দুটি মানুষের বয়স মাত্র ৩০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে। এদের আত্মীয়রা জানান, তাদের দুজনেরই ১টি করে সন্তান রয়েছে যাদের বয়স হবে ৪ ও ৫ বছর। এদের এই দুটি বাচ্চা বাবাহারা এবং এতিম হওয়ার কারণ শুধুমাত্র এই ডাম্পার। আর একই ঘটনায় যে দুজন মারাত্মক আহত হয়েছে তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর চট্রগ্রাম মেডিকেলে গতকাল শুক্রবার মারা যান। আহত আরেক যুবক শাওনের অবস্থাও খুবই খারাপ। বেঁচে থাকলেও তাকে পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।

সদর হাসপাতালে লাশ দেখতে আসা সচেতন অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন পুলিশের উপর। এ সময় তারা বলেন, পুলিশ ইচ্ছে করলে সকল লাইসেন্সবিহীন ও বেপরোয়া চালককে সনাক্ত করতে পারে ও তাদেরকে গাড়ি চালানো থেকে বিরত রাখতে পারে। কিন্তু পুলিশ তা করছে না অজ্ঞাত কোনো এক কারণে।

এ সময় এক যুবক বলে উঠেন আমি নিজে মোটরসাইকেল ব্যবহার করি। এই বছরে নিরাপদ সড়কের কড়াকড়ির কারণে আমি বাধ্য হয়েছি আমার গাড়ির কাগজপত্র ঠিক করতে। সে সময় আমরা পত্রিকায় দেখেছি আইন ভঙ্গকারী পুলিশ অফিসারকেও জরিমানা দিতে হয়েছে। সে সময় বেপরোয়া ও কাগজপত্রহীন সকল মোটর সাইকেলের বিষয়টি পুলিশ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। একই কায়দায় পুলিশ সুপার সাহেব ডাম্পারের উপর কড়াকড়ি আরোপ করলে বেপরোয়া চলাচল পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে ও প্রতিদিন দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাবে আমাদের অনেক যাত্রী সাধারণ।

বেপরোয়াভাবে ডাম্পার চালানোর একটি কারণ হচ্ছে- মালিককে দৈনিক ৫ হাজার টাকা জমা দেয়া। ডিজেলসহ অন্যান্য খরচ চালকের উপর। এ অবস্থায় একজন চালককে দৈনিক কমপক্ষে ৮ হাজার টাকা রোজগার করতে হয়। এই টার্গেট পূরণ করতেই তারা ঊর্ধ্বশ্বাসে গাড়ি চালায়। আর তখনি ঘটে দুর্ঘটনা।

সড়কে চলতে গিয়ে বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছেন এমন একজন মোটরসাইকেল চালক মাহফুজ। তিনি একটি স্টীল রড কোম্পানির মার্কেটিংয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পদে চাকুরি করেন। তিনি জানান, ডাম্পারগুলোর চালকরা কোনো চালকের আওতায় পড়ে না। তারা বামে গেলে ডানের, আর ডানে গেলে বামের ইন্ডিকেটর দিয়ে রাখেন। আবার হঠাৎ করে সামনে এসে ইমার্জেন্সী লাইট জ্বেলে দেয়। আবার পেছনে চলতে গিয়ে হঠাৎ করে সামনে এসে ব্রেক কষে বসে, সবচে ভয়ানক বিষয় হলো সড়কে তারা নিজেরাই চলতে গিয়ে একে অন্যের সাথে চরম প্রতিযোগিতা দেয়। এতে অহরহ দুর্ঘটনার শিকার হতে দেখা যায়। এমনভাবে হেলপার গাড়ি চালায় মনে হবে সে যুদ্ধে যাচ্ছে!

এ বিষয়ে একজন চালকের সাথে কথা হয়। এই চালকের নাম রফিক। বাড়ি রামু। ব্রীক ফিল্ডের ইটের ভাড়া নিয়ে কক্সবাজার এসেছে, অবশ্য তার এই গাড়িতে নাম্বার ছিলো না। তিনি জানান, গাড়ি আমার নয়। মালিককে প্রতিদিন ৪ হাজার টাকা করে দিতে হয়। ডিজেল ও লেবার খরচ আমাদের নিজেদের। তাই খরচ উঠাতে গেলে সারাটা দিন দৌড়ের মধ্যে থাকতে হয়। একটি মিনিট বসে থাকলে লস।

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক ডিজেল চালিত ৬ চাকার হুলার জাতীয় একটি বাহন এই ডাম্পার। বাহনটি অতিরিক্ত ভারী হওয়ার কারণে চালকরা ইচ্ছে করলেই তা মুহূর্তেই সড়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আর তাই অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। আর এই ঘাতককে নিয়ন্ত্রণ না করলে প্রতিদিন মানুষ মরবে অথবা পঙ্গু হবে। চালক না চালিয়ে প্রায় হেলপার চালায় এমন দেখা যায়।

তাছাড়া এই জেলায় যে পরিমাণ বৈধ তথা রেজিস্ট্রেশনকৃত ডাম্পার রয়েছে তার সমপরিমাণ রয়েছে অবৈধ। অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এসব অবৈধ ডাম্পার রাস্তায় চলছে। জনগণ কক্সবাজার পুলিশ সুপারের কাছে প্রত্যাশা করছে, তিনি অচিরেই কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে সড়কের এই ঘাতক ও মূর্তিমান আতঙ্ক ডাম্পার থেকে জনগণকে রক্ষা করবেন।

পাঠকের মতামত: