ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

উপকূলে দাম নেই লবণের, হতাশ চাষীরা

পেকুয়া প্রতিনিধি ::
পেকুয়ায় ফের লবণের দরপতন হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে উৎপাদিত প্রতি কেজি কাঁচা লবণের বর্তমান বাজার মুল্য মাত্র ৭.৫০ টাকা। সে হিসেবে প্রতি মণ লবণের দাম ৩শ টাকা। এ মুল্য বর্তমানে সর্বোচ্চ। লবণ বিক্রির এ মুল্য অঞ্চলভিত্তিক কিছুটা তারতম্য দেখা দেয়। কোথাও কোথাও বিক্রিমুল্য ১০/২০ টাকা এ দিক সেদিক হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে কাঁচা লবনের বিক্রিমুল্য সর্বোচ্চ ৩শ টাকা মণ প্রতি। পরিশোধন ও অপরিশোধন লবণের মুল্য নিয়ে ব্যাপক তারতম্য পরিলক্ষিত হয়েছে।

কৃষক কাঁচা লবণের দাম কম পেয়ে থাকলেও পরিশোধনযোগ্য বাজারজাত কৃত প্যাকেট লবণের দাম আকাশচুম্বী। বর্তমান কাঁচা লবণের দরের পতন হয়েছে। গত ১ মাসের ব্যবধানে মাঠ থেকে উৎপাদিত কাঁচা লবনের বিক্রি বাজার  উঠানামা করছে। কিছুদিন দর বাড়লেও পরবর্তীতে দরের পতন হয়েছে।

লবণ বিক্রির বাজার মুল্য কিছু দিন চাঙ্গাভাব ছিল। এতে করে উপজেলা পেকুয়াসহ উপকুলের লবণ বিক্রিতে চাঙ্গাভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। গত কয়েক দিনের ব্যবধানে আবারও লবণের দামের পতন হয়েছে। এ দিকে পেকুয়ায় লবণের পরিমাপ নেই গত ১৫ দিন ধরে।

গত ১০ দিন কাঁচা লবণের মুল্য কিছুদিন অপরিবর্তিত ছিল। সে সময় প্রতি কেজি কাঁচা লবণ বিক্রি হয়েছে ৮ টাকার চেয়েও বেশী। প্রতি মণ ৩শ ৪০ টাকা বিক্রি হয়েছে। লবণের সেই চাঙ্গাভাব আবারও নিন্মমুখী হয়েছে। চলতি লবণ উৎপাদন মৌসুমে পেকুয়াসহ উপকুলে সর্বাধিক লবণ উৎপাদিত হয়।

২০১৭ ও ২০১৮ ইং লবণ মৌসুমে কৃষক লবণ উৎপাদনের দিকে ব্যাপকভাবে উৎসাহ পেয়েছিলেন। এর আগের বছর লবণের দাম ছিল আকাশচুম্বী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সর্বোচ্চ মুল্য লবণের নির্ধারন ছিল। ওই অর্থবছরে কৃষক প্রতি মণ লবণ বিক্রি করে ৫শ ৫০ টাকা হারে। সেই হিসেবে প্রতি কেজি কাঁচা লবণের মুল্য ছিল ১৩.৭৫ টাকা হারে। লবণের আকাশচুম্বী দাম ছিল সে সুবাদে কৃষক সর্বোচ্চ দামে লবণ চাষের জমি আগাম নেয়।

২০১৭ ও ২০১৮ লবণ মৌসুমে প্রতি ৪০ শতক জমি আগাম নিতে কৃষকের ব্যয় হয়েছে সর্বনিন্ম ৪০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা। পানি, সেচ ও পলিথিন বাবদ প্রতি কানি জমিতে আরও ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার টাকা। শ্রমের মজুরী ও লবণ উৎপাদনে অন্যান্য যোগানসহ প্রতি কানিতে কৃষক প্রায় লক্ষাধিক টাকা মুলধন ব্যয় করে। ওই অর্থবছরে গড় কানি প্রতি লবণ উৎপাদিত হয়েছে ২শ থেকে ২৫০ মণ। লবণের দর পতন ছিল। উৎপাদনকারী এ সব কৃষক লোকসানে পতিত হয়।

এ সময় দর পতন হওয়ায় কৃষক লবণ উৎপাদন সময়ে বিক্রি থেকে বিরত ছিল। অগ্রাহায়ন মাস থেকে লবণ উৎপাদন শুরু হয়। বাংলা বৈশাখ মাসে মাঝামাঝি সময়ে লবণ উৎপাদন থেমে যায়। প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষক সমুদ্রের পানি থেকে এ লবণ উৎপাদন করে। সূর্যের তেজষ্ক্রিয়তা ও আলোক রশ্মি থেকে সমুদ্রের লবণ পানি সংরক্ষন করে বিশেষ কায়দায় কঠোর পরিশ্রমে এ লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে। কৃষক কায়িকশ্রমের মাধ্যমে এ লবণ উৎপাদন করে। তবে বর্তমানে লবণের বাজারমুল্যের পতন হয়েছে।

স্থানীয় সুত্রে জানায়, পেকুয়াসহ উপকুলে হাজার হাজার টন লবণ মজুদ আছে। লবণের বাজারমুল্য নিন্মমুখী হওয়ায় কৃষক এ সব উৎপাদিত লবণ বিক্রি না করে মজুদ করেছেন। পেকুয়ায় ৭ ইউনিয়নে বিপুল পরিমাণ কাঁচা লবণ মাঠে মজুদ রয়েছে। মৌসুমে লবণের দাম কম থাকলেও বর্ষার দিকে চাঙ্গা হয়। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে কৃষক এ সব লবণ বিক্রি না করে মজুদ রাখে। মগনামাসহ পেকুয়া উপজেলায় কাঁচা লবণ মজুদ বেড়ে গেছে। বিশেষ একটি সুত্র জানায়, সরকার ফের লবণ আমদানীর দিকে ঝুঁকছে। সম্প্রতি এ খবর কৃষক পর্যায়ে পৌছে যায়। এর প্রেক্ষিতে পেকুয়াসহ উপকুলে লবণ আমদানীর এ খবরে কৃষককুলে বেড়েছে হতাশা। লবণ পেকুয়াসহ উপকুলের অন্যতম অর্থকরী সম্পদ।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিসিক সুত্র জানায়, কক্সবাজার জেলা ও চট্রগ্রামের আংশিক সহ বাংলাদেশের উপকুলভাগে লবণ উৎপাদন হয়। লবণ উৎপাদনের সর্বোত্তম সময় হচ্ছে শুস্ক মৌসুম। গেল লবণ মৌসুমে কক্সবাজার জেলাসহ উপকুলে প্রায় ৭২ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন হয়। প্রতি একর লবণ উৎপাদন করতে একের অধিক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন ছিল প্রায় ১৪ লাখ মেট্রিক টন। তবে আবহাওয়া লবণ উৎপাদনের অনুকলে থাকায় প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশী লবণ মাঠে উৎপাদিত হয়েছে। বাংলাদেশে লবণের জাতীয় চাহিদা নির্ধারন করা হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন। সে হিসেবে উৎপাদিত লবণ বাংলাদেশে চাহিদা মেটাতে সক্ষম। একটি স্বার্থন্বেষী মহল লবণ শিল্প নিয়ে গভীর সংকট তৈরী করছে। তারা সরকারকে ভূল তথ্য দিয়ে ফের লবণ আমদানির দিকে ধাবিত করছে। একটি দায়িত্বশীল সুত্র জানায়, ফের লবণ আমদানির এ গুজব উপকুলে সম্প্রতি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর মাত্র কয়েক মাস পর বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হবে।

কক্সবাজারের ৪ টি সংসদীয় আসন আছে। এ জেলায় লবণ ও মৎস্য সম্পদের উপর নির্ভরশীল। প্রায় ২ লাখ মানুষ লবণ খাতে নির্ভরশীল। এ জেলার অর্থনীতির প্রাণের অন্যতম স্পন্দন এ লবণ। সেটি হয়ে থাকলে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ভোটে প্রভাব পড়বে নিশ্চিত। মাতারবাড়ীর কৃষক মোসলেম উদ্দিন, আলী আজগর জানায়, সংকট তৈরী হয়েছে লবণ নিয়ে। আমরা বাপ দাদার এ পেশা ছেড়ে যাব কোথায়? কর্ম নেই।

এ ভাবে দরের পতন অব্যাহত থাকলে পথে বসতে হবে লবণ চাষীদের। ধলঘাটার লবণ চাষী মোস্তাক ও হেলাল জানায়, পড়তা মিলছে না এ লবণে। এক মণ লবণ উৎপাদন করতে টাকা লাগে প্রায় ৩শতের বেশী। আর বিক্রি হচ্ছে বর্তমানে ৩শতের নীচে। করিয়ারদিয়ার সাবেক মেম্বার ও আ’লীগ নেতা সিরাজুল মোস্তফা জানায়, এমনি দাম নেই। তবে মানুষ লবণ পরিবহনে বিড়ম্বনায় ভোগছে।

কুতুবদিয়া চ্যানেল মহেশখালী চ্যানেল ভরাট হয়ে গেছে। মাতারবাড়ির কয়লা বিদ্যুতের নি:স্বরিত বর্জ্য ও পলি নদীতে গিয়ে মিশছে। এতে নদী ভরাট হচ্ছে। নৌপথে লবণ পরিবহন বন্ধ রয়েছে। লবণ আমদানীর সিদ্ধান্ত হবে সরকারের জন্য হটকারী। কিছু দালাল সরকারকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে লবণ আমদানীর দিকে ধাবিত করছে। হাজার হাজার টন লবণ মাঠে মজুদ আছে। এ গুলোর পরিসংখ্যান বের করতে হবে।

মনির উদ্দিন, ছরওয়ার উদ্দিন,আবুল কালাম ও মহেশখালীর লবণ চাষী আবুল হোসেন ও মগনামা,উজানটিয়া ইউনিয়নের লবণ চাষী  মোহাম্মদ সাদেক, আবু সুফিয়ান, লালমিয়াসহ আরও লবণচাষী জানায়, কিছু দিন লবণের দরের চাঙ্গাভাব হয়েছিল। ৩শ টাকার বেশী বিক্রি হয়েছে কাঁচা লবণ। বর্তমানে ৩০ থেকে ৪০ টাকা মণপ্রতি দাম কমেছে। প্যাকেট লবনের দাম অপরিবর্তিত। তবে উঠানামা করছে মাঠের কাঁচা লবনের দাম।

পাঠকের মতামত: