ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীর ভাঙন ঝুঁকিতে সড়কসহ অসংখ্য স্থাপনা

গ্রামের মানুষের মাঝে মাতামুহুরী মানে দীর্ঘশ্বাস, দুর্ভোগ-কষ্টের আক্ষেপ। যে নদী কেড়ে নিয়েছে তাদের সর্বস্ব। মাত্র দু’ দশকেই ভাঙনে অন্তত দশ হাজার বসতভিটে বিলীন হয়েছে।

এম. জাহেদ চৌধুরী, চকরিয়া ::

বান্দরবানের আলীকদমস্থ গহীন অরণ্য থেকে কক্সবাজারের সাগর-মোহনা পর্যন্ত মাতামুহুরী নদীর দৈর্ঘ্য ২৮৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে চকরিয়া উপজেলার মাঝ দিয়ে গেছে প্রায় শত কিলোমিটার নদীর অংশ। এই নদী কারো জন্য আশীর্বাদ হলেও আবার অনেকের জন্য অভিশাপ হয়ে উঠেছে। উজান থেকে নেমে আসা পলি মাটি ও বালি জমে ভরাট হয়ে গেছে মাতামুহুরী নদী। এক সময়ের প্রবাহমান নদীটিতে এখন শুষ্ক মৌসুমে নৌ চলাচলও করতে পারে না। অথচ দুই দশক পূর্বে ট্রলারসহ নানা নৌযান পণ্য নিয়ে চকরিয়া হয়ে লামা পর্যন্ত যেতো। সেই নদী তলদেশের সামান্য অংশ দিয়ে ছড়াখালের মতো পানি চলাচল করলেও বৃহদাংশে চর জেগে খেলার মাঠও ফসলি জমিতে রূপ পেয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, উজানের লামা ও আলীকদম উপজেলা বনাঞ্চলের বৃক্ষরাজি কাটার পাশাপাশি গোড়ালিও উত্তোলন করে ফেলায় এবং নিয়মিত পাহাড় কেটে পাথর উত্তোলন করায় ছোট-বড় পাহাড়গুলোর মাটি বৃষ্টির পানির সাথে ভেসে এসে মাতামুহুরীর তলদেশ ভরাট হয়ে যায়। এতে মাতামুহুরী নদীর দু’কূল ভাঙছে হরদম। বিশেষ করে বর্ষা আসলেই নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা ভাঙনের কবলে পড়ার ভয়ে আতঙ্কে থাকে। মাত্র দু’ দশকেই এই নদীর ভাঙনে অন্তত দশ হাজার বসতভিটে বিলীন হয়েছে। চকরিয়ার পুরনো চিরিংগা বাজার, তৎসংলগ্ন মামা-ভাগিনার মাজার, কবরস্থানের আংশিক, পুরনো থানা ও হাসপাতালের ভিটে তলিয়ে গেছে নদীতে। কাজির পাড়া, বেতুয়াবাজার, সীতারখিল, ছোট ভেওলা, লক্ষ্যারচর, সাহারবিল, কাকারা, মানিকপুর, ফাঁসিয়াখালী, পৌরসভার একাংশ ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে।
এই নদীতে পাহাড়ি ঢল নেমে পলি পড়ায় আবাদি জমিতে ভালো ফলন হলেও ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। এই ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে ১৯৯১ সাল থেকে চকরিয়ার মানুষ সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে মাতামুহুরী নদীতে ড্রেজিং করার জন্য। তাদের বক্তব্য, সাত থেকে দশ ফিট গভীর ড্রেজিং করলে এবং নদীর আঁকা-বাঁকা অংশ সোজাকরণের পাশাপাশি কিছু কিছু অংশে বাঁধ ও ব্লক দেয়া হলে ভাঙন অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
কাকারা ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ শওকত ওসমান চকরিয়া নিউজকে বলেন, মাঝেরফাঁড়ি অংশে বেড়িবাঁধ দেয়ায় ঢলের ক্ষতি থেকে চলতি বর্ষায় কাকারার অনেক বাসিন্দা রক্ষা পেয়েছে। দিঘির নিকটবর্তী হাজিয়ান সড়কের সেতু পয়েন্টে একটি স্লুইস গেট বসানোর পাশাপাশি আরো ৫-৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ দেয়া হলে এবং ওই বাঁধের কিনারে নদী অংশে ব্লক ফেলা হলে বন্যা ও ভাঙন থেকে লাখো মানুষ রক্ষা পাবে।
ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী চকরিয়া নিউজকে বলেন, দিগরপানখালী এলাকায় বেড়িবাঁধ দেয়া হলেও তা টেকসই করে রাখতে আরো ব্লক এবং মাটি দিতে হবে। পাশপাশি নির্মিত বাঁধের দৈর্ঘ্য আরো বাড়াতে হবে।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র মো. আলমগীর চৌধুরী  চকরিয়া নিউজকে  বলেন, মাতামুহুরী নদীর পৌরসভার অংশে ভাঙন রোধকল্পে ইতিপূর্বে দু-একটি স্থানে শহর রক্ষা বাঁধ দেয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ অন্য স্থানে বাঁধ নির্মাণ করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, চকরিয়া-বদরখালী-মহেশখালী সড়কের উত্তরপাশে বাটাখালী সেতু সংলগ্ন সাহারবিলের শীলপাড়ার অবস্থান। বাটাখালী সেতু থেকে ইটবিছানো সড়ক দিয়ে উত্তরে গেলে সাহারবিল আনওয়ারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা। সড়কটি দিয়ে ৫০ মিটার উত্তরে গেলেই সড়কের আর চিহ্ন নেই। সড়কের এই অংশটি (৫০০ মিটার) পাশের মাতামুহুরী নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। নদীর পাশেই গাছের তক্তা দিয়ে সাঁকো বানিয়ে মানুষ পার হচ্ছে। এখনও নদীর গর্ভে নারিকেল গাছ, বসতঘরের চালা ও সড়কের কিছু স্মৃতি চিহ্ন ভেসে রয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে মাতামুহুরী গ্রাস করতে পারে আরও কিছু বসতঘর। এসব ঘরের আঙিনা ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে।
শীলপাড়ার দুলাল সুশীল, সাধন সুশীল, তপন সুশীল, মানিক সুশীল, সচিন্দ্র সুশীল, যদু সুশীল, রাখাল সুশীল, সুবল সুশীল, রতন সুশীল, বিধান সুশীল, হৃদয় শীলের বসতঘর গত বর্ষায় মাতামুহুরী নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছে। তাদের সবার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। বসতঘর হারা হৃদয় শীল চকরিয়া নিউজকে  বলেন, দেশে এতো নেতা, এতো প্রশাসন, এতো জনপ্রতিনিধি, দু:খের সময় কাউকেই পাইনি। বসতঘর হারিয়ে এখন অন্যের আঙিনায় থাকি। কেউ কোনোদিন একটু দেখতেও আসলো না, খবরও নিলো না। সচিন্দ্র সুশীল (৫৫) বলেন, গত দশ বছরে অন্তত একশত বসত ঘর, দুটি মন্দির ও চলাচলের একমাত্র সড়কটি মাতামুহুরীর গর্ভে বিলীন হয়েছে। উদ্ধাস্তু হয়েছে বহু মানুষ। এখন লোকজন বসত-বাড়ির উঠানের ওপর দিয়ে হাঁটছে।
আনওয়ারুল উলুম ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার ফাজিলের (ডিগ্রী) শিক্ষার্থী জন্নাতুল মাওয়া  চকরিয়া নিউজকে বলেন, প্রতিদিন শীলপাড়া সড়কটি দিয়ে মাদ্রাসায় আসা যাওয়া করতে খুব কষ্ট হয়। গাড়ি চলে না। প্রতিদিন হেঁটে আসা যাওয়া করতে হয়। বৃষ্টি হলে হেঁটেও যাওয়া যায় না।
সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আলহাজ মহসিন বাবুল  চকরিয়া নিউজকে বলেন, শীলপাড়ার মানুষের আর্তনাদের কথা লিখিতভাবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে জানানোর পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা সরেজমিনে ঘুরে গেছেন। এলাকার মানুষ ভাঙনরোধে স্থায়ী সমাধান চায়। এজন্য বড় প্রকল্প নিয়ে জিও ব্যাগ বা ব্লক দিয়ে কাজ করতে হবে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান  চকরিয়া নিউজকে বলেন, সরেজমিনে শীলপাড়া এলাকায় মাতামুহুরী নদীর ভাঙন পরিদর্শন করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। শিগগিরই পজিটিভ কিছু একটা হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, কক্সবাজারের চিরিংগা শাখা কর্মকর্তা (এসও) তারেক বিন ছগির  চকরিয়া নিউজকে বলেন, সাহারবিলের শীলপাড়া এলাকার ৫০০ মিটার ভাঙন নিয়ে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ইতিমধ্যে তিনশত মিটারের একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। এতে এক কোটি টাকার কাছাকাছি একটা বরাদ্দ হতে পারে। জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন ঠেকানো হবে। দরপত্রের কাজ শেষ হলেই কাজ শুরু হবে।

পাঠকের মতামত: