ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

উখিয়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল যেন দুর্নীতির আখড়া: একই উপজেলায় ১২ বছর যাবৎ চাকুরি

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ::
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিষয়টি গোপন করে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাঁচ’শ গভীর নলকুপ বিতরনে উখিয়ার জনস্বাস্থ্য উপসহকারী প্রকৌশলী কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আগমনে উখিয়া টেকনাফের অধিবাসিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ জন্য সরকার স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সুবিধার্থে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের সেবায় বরাদ্দকরা ৫’শ গভীর নলকুপের সরকারী ফি মওকুফ করে দিয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশ গোপন রেখে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল উখিয়া কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পাঁচ’শ গভীর নলকুপ বরাদ্দ দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে এক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
জানা যায়, গত বছরের ২৬ আগস্ট হতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে উখিয়া টেকনাফ এলাকায়। ওসব রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে গিয়ে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের মধ্যে বিতরনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঈদউপহার হিসেবে নগদ টাকা, চাল, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে যাদের ঘর ভাঙতে হয়েছে তাদের ঘর নির্মাণের ব্যবস্থা ও নলকুপসহ বিভিন্ন সহায়তা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ইতোপূর্বে গভীর নলকুপ স্থাপনে গ্রাহকদের কাছ থেকে নামমাত্র একটি সহায়ক চাঁদা (ফি) নেয়ার বিধান ছিল। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের সেবা দিতে সরকার ওই টাকা মওকুফ করে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর বরাবর পত্র ইস্যু করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে।
সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার বিভাগ পাস-১ অধিশাখা থেকে উপ সচিব মো: খাইরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত গত ৩০জানুয়ারি নির্দেশনাক্রমে ইস্যুকৃত পত্রে জানানো হয়েছে, মিয়ানমার হতে আগত বাংলাদেশে আশ্রিতদের জন্য এবং ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য স্থাপিত ও স্থাপিতব্য নলকুপের সহায়ক চাঁদা মওকুফ করা হয়েছে। পত্রে আরও বলা হয়েছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর হতে উখিয়া টেকনাফ উপজেলায় মিয়ানমার থেকে আগত আশ্রিতদের ক্যাম্পে নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহের লক্ষ্যে এবং আশপাশের ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য জরুরী পরিস্থিতিতে স্থাপিত ও স্থাপিতব্য গভীর-অগভীর নলকুপের সহায়ক চাঁদা আদায়ের জন্য অনূকুল পরিস্থিতি না থাকায় আশ্রিতদের ক্যাম্পে ও ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য গভীর ও অগভীর নলকুপের সহায়ক চাঁদা মওকুফ করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো: রশিদুল হক মন্ত্রণালয়ের স্মারকের অনুবলে সঙ্গে সঙ্গে পত্র ইস্যু করে চট্টগ্রাম সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলীকে অবগত করিয়েছেন। তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর উখিয়ার উপসহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ গোপন রেখে উখিয়া টেকনাফে বরাদ্দকৃত ৫’শ গভীর নলকুপ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে সহায়ক চাঁদা (ফি) হিসেবে ২০-২৫ হাজার টাকা হারে আদায় ও আত্মসাত করেছে।
গ্রাহকরা অভিযোগ করেছেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাকে তোয়াক্কা না করে উখিয়ার উপসহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন উখিয়ায় ৪৬৪টি এবং টেকনাফে ৩৬টি গভীর নলকুপ বিতরণ করে সহায়ক চাঁদা হিসেবে জনপ্রতি ২০থেকে পঁচিশ হাজার টাকা হারে হাতিয়ে নিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ তালিকা মতে, নিরাপদ খাবারের পানি সরবরাহের লক্ষ্যে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ও উখিয়া টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য ক্যাম্পে ৫’শ এবং আশপাশের ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ৫’শ গভীর নলকুপ বরাদ্দ করেছে সরকার। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের এবং ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সেবায় এক হাজার নলকুপ স্থাপনে সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ১১কোটি টাকারও বেশী। জরুরী পরিস্থিতিতে স্থাপিত ও স্থাপিতব্য নলকুপের সহায়ক চাঁদা আদায়ের জন্য অনূকুল পরিস্থিতি না থাকায় সরকার জনসেবার লক্ষ্যে তাও মওকুফ করে দিয়েছে। অথচ উখিয়ার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয়ে দায়িত্বরত উপসহকারী প্রকৌশলী ইকবাল হোছাইন সহায়ক চাঁদা মওকুফের বিষয়টি স¤পূর্ণ গোপন রেখে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় এক কোটি টাকা। এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও সহায়ক চাঁদা মওকুফের বিষয়টি বুঝতে দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন উখিয়ার চেয়ারম্যান-মেম্বারগণ।
পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, গভীর নলকুপ স্থাপনকল্পে গ্রাহকদের কাছ থেকে উপসহকারী প্রকৌশলী নিজ হাতে টাকা আদায় করেছে বলে শুনেছি। মন্ত্রণালয় থেকে ফি মওকুফ করার বিষয়টি আমাদের মোটেও জানানো হয়নি। সরকারীভাবে ফি মওকুফের ব্যাপারটি জানাজানি হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে উখিয়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী লোভ সামাল দিতে না পেরে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ‘চাঁদা মওকুফের’ বিষয়টি গোপন করে সরকারের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করেছে। জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
সরকারের নির্ধারিত ফি মওকুফ বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর চট্টগ্রাম সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জহির উদ্দিন দেওয়ান বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে সহায়ক চাঁদা মওকুফ করার নির্দেশনা সংবলিত পত্র কক্সবাজারে নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবরে পাঠানো হয়েছে। টাকা আদায় সংক্রান্ত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ঋত্বিক চৌধুরী একই কথা বলে জানান, অভিযোগটি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে টাকা নেয়ার বিষয়টি সত্য নয় দাবী করেছেন উখিয়ার উপসহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন।

পাঠকের মতামত: