ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘আমি দুষ্টামি করব না, মাকে ফিরে আসতে বলবেন’ সাতকানিয়ায় পদদলন : নিহতদের বাড়িতে শোকের মাতম

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, সাতকানিয়া ::

মা আকাশে চলে গেছে। আর ফিরে আসবে না। আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি আর কোনোদিন মা বলে ডাকতে পারব না। আপনাদের সাথে দেখা হলে মাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন। আমি কথা দিলাম, আর কোনোদিন দুষ্টামি করব না। মাকে কষ্ট দেব না। খাবারের জন্য কান্না করব না। শুধু মা বলে ডাকতে পারলে হবে। মাকে আমার কাছে ফিরে আসতে বলবেন।

কথাগুলো বলছিল লোহাগাড়ার উত্তর কলাউজানের রসুলাবাদ পাড়ার জ্যোৎস্না আকতারের নয় বছরের শিশু কন্যা তাহমিনা আকতার। কথা বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। গত সোমবার সকালে সাতকানিয়ার নলুয়ায় পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা কাদেরিয়া মঈনুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা মাঠে কেএসআরএমের পক্ষ থেকে ইফতার সামগ্রী দেওয়ার সময় পদদলনে নিহত হয় তার মা। গতকাল দুপুরে তাদের বাড়ির সামনে পৌঁছার সাথে সাথে অসুস্থ বাবার হাত ধরে সামনে আসে বাক প্রতিবন্ধী দেলোয়ার হোসেনসহ জোৎস্নার চার শিশু সন্তান। তাহমিনার প্রশ্ন, আমার মা কি ফিরে আসবে? বাবা বলেছিল, আমি দুষ্টামি না করলে মা আবার ফিরে আসবে। আমার মায়ের সাথে আপনাদের দেখা হয়েছে? আসবে বলেছে? ফিরে না এলে আমি কাকে মা বলে ডাকব?

তার কথার কোনো উত্তর নেই। উপস্থিত সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। পরে অসুস্থ বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করল, তোমার মা ফিরে আসবে। ফিরে না এলে আমরা কাকে নিয়ে বাঁচব? আমাদেরকে কে খাওয়াবে? আমার জন্য কে ওষুধ কিনে আনবে?

মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই কান্না শুরু করলেন জোৎ্নার স্বামী আবদুল হাফেজ। অশ্রুভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি বড় হতভাগা। বিয়ের পর থেকে অভাবের মধ্যে গেছে জোৎস্নার জীবন। ওর কোনো আশা পূরণ করতে পারিনি। বিয়ের কিছুদিন পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। এক পর্যায়ে কাজ করার শক্তি হারিয়ে ফেলি। তখন আমাকে বিশ্রামে রেখে জীবনযুদ্ধে লিপ্ত হয় আমার স্ত্রী। হাতে তুলে নেয় কোদাল। আশপাশের মানুষের বাড়িতে, ক্ষেত–খামারে কাজ শুরু করে। জমিতে চারা রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, মাটি কাটা, পাহাড় থেকে কাঠ কাটা, রাস্তা নির্মাণের কাজণ্ডসব করেছে। মানুষের বাড়িতে সারা দিন খেটে রোজগার করে আমাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে। স্ত্রীর টাকায় চলেছে আমার চিকিৎসার খরচ।

তিনি বলেন, জোৎস্না আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমি কাকে নিয়ে বাঁচব? আমার অবুঝ চার শিশুকে কার হাতে তুলে দেব? আমার হাতে একটা টাকাও নেই। সন্তানদের কী খাওয়াব? আমি এখন বড় নিরুপায়।

এসব কথা বলতে বলতে সন্তানদের জড়িয়ে ধরে বিলাপ করেন আবদুল হাফেজ। তিনি বলেন, অনেক দিন পর জোৎ্না মুক্তি পেয়েছে। সংসারের অভাব তাকে আর তাড়া করবে না। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার চিন্তা তাকে ঘিরে ধরবে না। আমার ওষুধের টাকা জোগাড় করার জন্য চিন্তায় অস্থির হতে হবে না। আমাদের সবার কাছ থেকে ছুটি নিয়েছে। মৃত্যু তাকে অভাব থেকে মুক্তি দিয়েছে। যাক, সারা জীবন তো কষ্টই করেছে। এবার একটু বিশ্রাম নিক। শান্তিতে ঘুমাক।

বাবার এসব কথা শুনে একটু দূরে বসে কান্না করছিল জোৎস্নার বড় মেয়ে তানজিনা আকতার। তানজিনা বলে, আমাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য মা দিন–রাত খেটে গেছেন। নিজের শরীরের যত্ন নেননি। গত রবিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে পান্তাভাত খেয়ে মাটি কাটার কাজে চলে যান। দুপুরে কিছুই খাননি। রাতে ঘরে এসে দেখেন চাল নেই। তখন অন্যের কাছ থেকে চাল এনে আমাদের হাতে তুলে দেন। মা না খেয়ে এলাকার অন্য মহিলাদের সাথে ইফতারি আনার জন্য সাতকানিয়ায় চলে যান। মাকে বলেছিলাম, একটু অপেক্ষা করার জন্য। রান্না শেষ হলে দু মুঠো ভাত খেয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আশপাশের অন্য মহিলারা চলে যাওয়ায় মা অপেক্ষা করেননি। রমজানে আমাদের মুখে ভালো খাবার তুলে দেওয়ার আশা নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন সাতকানিয়ার নলুয়ায়। কিন্তু ইফতারি নিয়ে ফেরা হয়নি। মা ফিরেছেন লাশ হয়ে। আমরা এখন কার কাছে যাব, কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।

শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হলো না টুনটুনির

মেহেদীতে আমার মেয়ের হাত রাঙানো হলো না। স্বামী, শ্বশুর–শাশুড়ির হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পারলাম না। শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হলো না আমার আদরের টুনটুনির। এর আগে আল্লাহ তাকে তুলে নিয়ে গেছে। আমার মেয়েকে রেখে আল্লাহ আমাকে নিয়ে গেল না কেন?

এসব কথা বলতে বলতে বিলাপ করছিলেন পদদলিত হয়ে মারা যাওয়া লোহাগাড়ার উত্তর কলাউজানের রসুলাবাদ পাড়ার ফাতেমা বেগম টুনটুনির মা কোরবানি বেগম। মেয়ে হারানোর শোকে কথা বলতে পারছিলেন না। কিছুক্ষণ পর পর তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, সাতকানিয়ার কাঞ্চনা এলাকার এক ছেলের সাথে ১৫ দিন আগে মেয়ের বিয়ের কথা পাকা হয়। টাকা জোগাড় করতে না পারায় তারিখ দিতে পারিনি। বিয়ের টাকার জন্য অনেকের কাছে গেছি। কিছু জোগাড় হয়েছে, বাকি টাকা জোগাড় হলেই বিয়ের তারিখ দিতাম। কিন্তু এর আগেই আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে আল্লাহ। আমার বুক খালি করে চলে গেছে টুনটুনি। আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।

কোরবানি বেগম বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর দিনমজুরের কাজ শুরু করি। মানুষের বাড়িতে কাজ করে ছেলেমেয়েকে বড় করেছি। তাদের দিকে তাকিয়ে সারাজীবন খেটেছি। কিন্তু মেয়ে আমাকে শোকসাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে।

তিনি বলেন, ইফতার সামগ্রী দেওয়ার খবর পেয়ে এলাকার অন্য মহিলাদের সাথে আমরা মা–মেয়ে যাই। আমি একা যেতে চেয়েছিলাম। আমি অসুস্থ থাকায় মেয়ে আমাকে একা ছাড়েনি। আমাকে দেখাশোনার জন্য সে সঙ্গে যায়। রবিবার রাতে আমরা সেখানে গিয়ে হাজির হই। মা–মেয়ে একসাথে রাস্তায় বসে রাত কাটাই। ফজরের আজানের পর দুজন মাঠে প্রবেশ করি। কিন্তু সকালে ইফতার সামগ্রী বিতরণ শুরু হওয়ার পর গেটে একসাথে অনেক লোক হুড়োহুড়ি শুরু করে। তখন মেয়ে টুনটুনি আমার হাত থেকে ছুটে যায়। অনেকক্ষণ পর জানতে পারলাম সে অসুস্থ। তাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু না, বিকালে বুঝতে পারলাম, ও বেঁচে নেই। আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ইফতারি নয়, আমার মেয়ের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছি।

ইফতার সামগ্রী নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে নিহত ৯ নারীর বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। নিহতদের পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, স্বামীর দরিদ্র সংসার অথবা স্বামী পরিত্যক্তা এসব নারী ছেলেমেয়েদের মুখে ভালো খাবার তুলে দেওয়ার আশা নিয়ে ছুটে গিয়েছিল ইফতার সামগ্রী ও জাকাত নেওয়ার জন্য। অভাবের সাথে তারা যুদ্ধ করে আসছিল। স্থানীয়রা বলেন, সংসারের অভাব থেকে তারা সবাই মুক্তি পেয়েছে।

পাঠকের মতামত: