ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

অরক্ষিতই রয়ে গেল বিস্তীর্ণ উপকূল: বাঁধ নির্মাণে ধীরগতি, কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক ::

ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ। ১৯৯১ সালের এই দিনে সৃষ্ট প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বিরাণ ভূমিতে পরিণত করেছিল চট্টগ্রামসহ দেশের ১৫ জেলার ২৫৭ টি ইউনিয়নকে। এতে প্রাণ হারান ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। সেদিন বাতাসের গতিবেগ ছিল সর্বোচ্চ ২২০ কিলোমিটার। সমুদ্রে পানির উচ্চতা ছিল প্রায় ২৬ ফুট। এদিকে পরিবেশ বিজ্ঞানিরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের কারণে আগামীতেও ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। ২০৫০ এবং ২১০০ সালে যথাক্রমে ৩২ এবং ৮৮ সে.মি. সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। এতে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাগুলো কতটা সুরক্ষিত ? চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলার বেড়িবাঁধগুলোর সুরক্ষিত কী না সেই প্রশ্নও তুলেছেন স্থানীয় লোকজন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাব এবং চলমান কাজের ধীরগতির কারণেই অরক্ষিত রয়ে গেছে চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলার বেড়িবাঁধগুলো। ফলে চলতি মৌসুমে বড় ধরনের কোন জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিঝড় হলে সংশ্লিষ্ট উপজেলায় প্রাণহানিসহ বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। যদিও বেড়িবাঁধগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্ব থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দাবি, কোথাও দুর্বল বাঁধ নেই।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, সীতাকুন্ড, সন্দ্বীপ ও মিরসরাই একাংশ মিলিয়ে ২৬৫ দশমিক ২৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে বাঁশখালী উপজলায় ১৪১ দশমিক ১৪ কিলোমিটার, সীতাকুন্ড উপজেলায় ৩৩ দশমিক ৬২ কিলোমিটার, সন্দ্বীপ উপজেলায় ৫৮ কিলোমিটার, মিরসরাই উপজেলায় ৩২ দশমিক ২০ কিলোমিটার, আনোয়ারায় ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এছাড়া পতেঙ্গায় চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধের দৈর্ঘ্য ২১ কিলোমিটার। এর বাইরে রাউজান, হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়িতে বেড়িবাঁধ না থাকলেও সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন হালদা ও কর্ণফুলী নদীর ভাঙন আতংকে থাকেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধকে ঘিরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ করছে। উপকূলীয় এলাকাগুলোতেও বেড়িবাঁধকে ঘিরে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে এলাকার সাধারণ লোকজন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, লবণাক্ত পানি প্রবেশ, জলাবদ্ধতা হ্রাস, বাঁধের ভাঙ্গন রক্ষা, আবাদি জমি, ফসল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও মূল্যবান সম্পদ রক্ষা করা সহজ হবে। উপকূলীয় এলাকায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দারিদ্র বিমোচনেও প্রকল্পগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। যদিও স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন, বেশিরভাগ বেড়িবাঁধ এখনো অরক্ষিত এবং যেখানে প্রকল্পের কাজ চলছে সেগুলোও খুব ধীরগতিতে এগুচ্ছে।

আনোয়ারা উপকূলীয় বেড়িবাঁধ :

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জ্বলোচ্ছাসে পুরোপুরি বিলীন হয়ে গিয়েছিল আনোয়ারা উপকূলের ১৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। এরপর বিভিন্ন সময় বেড়িবাঁধ সংস্কার ও রিং বাঁধ নির্মাণের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিপুল অর্থ বরাদ্দ দিলেও তাতে দুঃখ ঘুচেনি উপকূলবাসীর। দীর্ঘদিন পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের চলমান ২৮০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে আনোয়ারা উপকূলীয় বাঁধের জন্য। তবে অভিযোগ আছে কাজের ধীরগতি নিয়ে।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, বর্তমানে যে গতিতে বেড়িবাঁধের কাজ চলছে তাতে আগামী বর্ষায় সাগরের জলোচ্ছ্বাস থেকে স্থানীয় উপকূলীয়বাসীর রক্ষা পাবার কোন ব্যবস্থা হচ্ছে বলে মনে হয় না। আনোয়ারা উপকূলীয় বাঁধের দক্ষিণ পরুয়া পাড়া, উত্তর পরুয়া পাড়া ও বারআউলিয়া অংশে ব্লক বসানো হলেও বাঁধের বিরাট অংশ রয়েছে ভাঙ্গাচোরা অবস্থায়। পূর্ব গহিরা অংশে ফকিরহাট ও হাড়িয়াপাড়া এলাকায় ৭১০ মিটার এলাকা বেড়িবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি ব্লক বসানোর কথা থাকলেও সেখানে কোন কাজ শুরু হয়নি।

বাঁশখালী বেড়িবাঁধের কাজেও ধীরগতি :

উপকূলীয় উপজেলা বাঁশখালীতে ২৫১ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে চলছে বাঁধ নির্মাণের কাজ। ৬টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ৩৪টি প্যাকেজে বাঁশখালীর উপকূলীয় বেড়িবাঁধের কাজ পায়। ২০১৫ সালের মে থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত এ বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ আছে। অভিযোগ আছে প্রকল্পের কাজ চলছে ধীরগতিতে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। বাঁধ এলাকার লোকজন অভিযোগ করেছেন, অনেক জায়গায় বাঁধ সংলগ্ন স্থান থেকে স্কেভেটার দিয়ে মাটি তুলে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেড়িবাঁধের কাজ যাতে সুষ্ঠু এবং সিডিউল অনুসারে হয় তার জন্য প্রতিনিয়ত তদারকি করা হচ্ছে। তারপরও যদি কোন সমস্যা হয় তা কাজ বুঝে নেয়ার আগে যথাযথ সংস্কার করে বিল প্রদান করা হবে।

উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, পরবর্তীতে ঘূর্নিঝড় রোয়ানু ও মোরার আঘাতে বাঁশখালীর ৬টি ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এরপর আড়াইশ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় বাঁশখালী উপকূলীয় বেড়িবাঁধে ১৭ লক্ষ ৮ হাজার ৪৭১টি ব্লক বসানো হবে। জিও ব্যাগ তৈরি করা হবে ৫ লক্ষ ৭৮ হাজার ১৫৭টি।

৩৫৮ কোটি টাকার প্রকল্প আটকে আছে :

বোয়ালখালী ও রাউজান অংশে কর্ণফুলী নদী এবং খালের ভাঙনরোধে ৩৫৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রকল্পটি এখনো আটকে আছে। এরিমধ্যে তাড়াহুরা করে নেয়া হয়েছে ৩১ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প। এ প্রকল্পে বাদ দেয়া হয়েছে রাউজান অংশকে। বৃহৎ আকারের প্রকল্প বাদ দিয়ে ছোট আকারের প্রকল্প গ্রহণের পিছনে আগামী নির্বাচনই উদ্দেশ্য বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংশিহ্মষ্টরা বলছেন, ৩৫১ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন দীর্ঘ সময়সাপে ের বিষয়। এছাড়াও নির্বাচনের আগে বড় অঙ্কের প্রকল্প অনুমোদনের নিয়ে শঙ্কাও রয়েছে। তাই রাউজান অংশ বাদ দিয়ে শুধু বোয়ালখালী অংশের জন্য আলাদাভাবে ৩১ কোটি টাকার প্রকল্প জমা দেয়া হয়েছে। তাই ছোট আকারের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলী নদীর বোয়ালখালী অংশের চরণদ্বীপ ঘাটিয়ালপাড়া সংলগ্ন এলাকা, বোয়ালখালী খালের ননাইয়ারমারঘাট, দুমুখো খাল, ছন্দরিয়াখালের বিনয় বাঁশী জলদাসের বাড়ি এলাকাসহ ৭টি পয়েন্টে ভাঙনরোধে সিসি ব্লক ফেলা হবে। দীর্ঘদিন ধরে নদী ও খালের ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে।

এর আগে ২০১৩ সালে অক্টোবর মাসে নির্বাচনের আগে ৭২ কোটি টাকার প্রকল্পটি উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন পানি সম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন। টেন্ডার প্রক্রিয়ার আগে উদ্বোধন করতে গিয়ে নানা সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছিল। শেষে তড়িঘড়ি করে তিন কোটি ৮২ লাখ টাকার টেন্ডার আহ্বান করে প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছিল।

পরিবেশবাদীরা যা বলছেন :

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ইদ্রিস আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আর্দ্র–ক্রান্তীয় অঞ্চলের দেশ যার উত্তরে হিমালয় এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এ ভৌগোলিক অবস্থা বাংলাদেশকে জীবন ধারণের জন্য শুধু উষ্ণ–আর্দ্র আবহাওয়া ও মৌসুমি বায়ু দেয়নি, দিয়েছে জীবন ও সম্পদ ধ্বংসকারী ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, বজ্রপাত, বন্যা, ভূমিকম্প এবং সুনামীর মতো দুর্যোগও। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় একটি ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার সংশ্লিষ্ট প্রবল বাতাসসহ তীব্র বৃষ্টিপাত এবং সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম।

তিনি বলেন, বিভিন্ন গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ এবং ২১০০ সালে যথাক্রমে ৩২ এবং ৮৮ সে.মি. সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। যার ফলশ্রুতিতে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। যদি এটা সত্য হয়, ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে আরও অতিরিক্ত আশ্রয়কেন্দ্রের প্রয়োজন হবে। তিনি উপকূলীয় এলাকার নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে বেড়িবাঁধ রক্ষার উপরও জোর দেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী স্বপন কুমার বড়ুয়া বলেন, চট্টগ্রামে বর্তমানে দুর্বল বাঁধ নেই। ১৯৯১ সালের মত অরক্ষিত নেই বা সেই ঝুঁকিতে নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডর যাচাই–বাছাই কমিটির সভায় ৩৫৮ কোটি টাকার প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রকল্পটি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। ৩১ কোটি টাকার প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রকল্পটি মন্ত্রণালয় থেকেই অনুমোদন দেয়া হবে।

পাঠকের মতামত: