ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

পাড়া মহল্লায় আইপিএল জুয়া নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ

অনলাইন ডেস্ক ::

 দৃশ্যপট ১

রাত তখন ১০টার কাটা ছুঁইছুঁই। নগরীর ওয়ার্লেস কলোনি এলাকার একটি চায়ের দোকানে প্রচ– ভিড়। না, মোটেই চা–নাস্তা করার জন্য প্রায় মধ্যরাতে এই ভিড়ের কারণ নয়। কারণ টাইগারদের কাটার–মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান। তাও আবার বাংলাদেশে নয়, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগে (আইপিএল)। সেখানে ২২ এপ্রিল রাতে মুস্তাফিজের মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স খেলছিল রাজস্থান রয়েলসের বিরুদ্ধে। ম্যাচে ফিজের দল হেরেছে, হেরেছে এদেশের অনেক তরুণ যুবাও। ভারতে আইপিএল অথচ এদেশে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকেই। এর কারণ বাজি, যাকে আইপিএল জুয়াও বলা হচ্ছে। তো সে ম্যাচে মুস্তাফিজ ৪ ওভার বল করে ৩৫ রানের বিনিময়ে উইকেট লাভ করেন মাত্র ১টি। ম্যাচের প্রতিটি ওভারে মুস্তাফিজ বল হাতে পেলেই ওয়ার্লেস কলোনির নির্দ্দিষ্ট সেই চায়ের দোকানে উপস্থিত অনেকেরই ব্যস্ততা বেড়ে যায়। সমানে চলে মোবাইলে টেপাটেপি। কেউ কেউ সরাসরি কল করেই টাকার অংক নির্দ্দিষ্ট করে দেন।
দৃশ্যপট ২
শেরশাহ এলাকার আইপিএল ম্যাচ চলাকালে এক বিকাল বেলা। ৫–৬ জনের একটি তরুণ দল খোলা জায়গার একপাশে বসে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছেন মুঠোফোনের দিকে। তারা যে ক্রিকেটের বড় ভক্ত। কিন্তু মাঝেমধ্য্ েদেখা মিলে, ব্যস্ত হয়ে সেই তরুণদের কেউ কেউ মুঠোফোনে কথা বলছেন কারও সাথে। কিছুক্ষণ পরপরই হাসি আবার হঠাৎ রাজ্যের বিষাদ। কারণ একটাই, বাজির বিষয়বস্তু মিলে গেলে মুনাফার হাসি আর না মিললে লোকসানের বিষাদ।
দৃশ্যপট ১ ও ২ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। মনে হতে পারে এটা বুঝি শুধু শেরশাহ কিংবা ওয়ার্লেস কলোনিরই দৃশ্য। আসলে আইপিএল মাঠে গড়ানোর পর থেকেই ক্রিকেট জুয়া ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে নগরীতে। সরেজমিনে ঘুরে ঝাউতলা, ওয়ার্লেস কলোনি, সেগুন বাগান, ঝাউতলা বাজার, সর্দার বাহাদুর নগরসহ নগরীর সর্বত্রই এই জুয়ার প্রকোপ দেখা যায়। নগরীর বাকলিয়া, ডিসি রোড, চকবাজার, খাতুনগঞ্জ–চাক্তাই, বহদ্দারহাট, মাদারবাড়ী, বাড়ইপাড়া, আগ্রাবাদ, খতিবের হাট, ফরিদের পাড়া, দেওয়ান বাজার, আগ্রাবাদ, জিইসি মোড়, সদরঘাট, অক্সিজেন, বায়েজিদ, শেরশাহসহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত জুয়ার আসর বসছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসন যদি এদিকটায় দ্রুত কোনো পদক্ষেপ না নেয় তাহলে আইপিএল ২০১৮এর দিন যতো গড়াবে ততোই এর প্রকোপ বাড়বে। তাছাড়া জুয়ার আসরকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত মারামারিসহ নানা অসমাজিক কর্মকা– বাড়ছে। বাড়ছে চুরি ও রাহাজানির মত ঘটনা।
ঝাউতলা এলাকার এক সমাজকর্মীর সাথে কথা বলে জানা গেলো, এই আইপিএল জুয়ার সাথে একটি চক্র জড়িত। সেই চক্রের বিশাল পরিমাণ অর্থ এতে লগ্নি করা। লগ্নিকৃত অর্থ লাভসহ তুলে আনতে তারা স্কুল–কলেজ পড়–য়া তরুণদের পাশাপাশি শ্রমজীবীদের টার্গেট করেই আইপিএল জুয়া বাণিজ্য চালাচ্ছে। এতে করে নিংস্ব হচ্ছেন অনেকেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই সমাজকর্মী দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, এই তো ক’দিন আগে এলাকার একজন ৫ লাখ টাকা আইপিএল বাজিতে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। আইপিএল জুয়ায় টাকার এই অংকটাই শেষ নয়। এখানে ৫০–১০০ টাকা থেকে বাজির অংক এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকাও উঠে যায়। দৈনিক পূর্বকোনের বিভিন্ন উপজেলা প্রতিনিধির সাথে কথা বলে জানা যায়, শুধু চট্টগ্রাম নগরীই নয়, আইপিএল জুয়া ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন উপজেলাতেও। প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল থেকে দৃষ্টি দেওয়া না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
আইপিএল ম্যাচ নিয়ে যেভাবে জুয়া হয় : ঝাউতলা এলাকায় একটি দোকানে মোবাইল–ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকা দুই যুবকের একজনের সাথে কথা বলে জুয়া ও টাকা লেনদেনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। বিশেষ কোনো বোলার এক ওভারে কত রান দেবে কিংবা কয়টি উইকেট পাবে তার ওপর ধরা হয় বাজি। কেউ ১০০ টাকা বাজি ধরে জিতলে তাকে দেয়া হয় ২০০ টাকা, ১০ হাজার টাকার বিপরীতে পাবেন ২০ হাজার টাকা, অর্থাৎ যে টাকা বাজি ধরা হয় তার দ্বিগুণ পান বিজয়ী ব্যক্তি। বাজি ধরে হেরে গেলে সেই টাকা চলে যায় বাজিকরদের পকেটে। এভাবে প্রতি বল, রান, ওভার, উইকেট সবকিছু নিয়ে বিভিন্ন অঙ্কের টাকার খেলা চলে আইপিএল নিয়ে। অনেক জুয়াড়ি আছে যারা এক পক্ষের সাথে অপর পক্ষের মোবাইলের মাধ্যমে বাজি ধরিয়ে দিতে সাহায্য করে। যদিও কার সাথে বাজি ধরা হয়েছে সেটাও জুয়ারিরা জানতে পারে না। কিন্তু যে জুয়াড়ি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করে দেয় সেই টাকা ওই মিডিয়া করা ব্যক্তিই উঠিয়ে এনে দেয়। যে টাকা থেকে ওই মিডিয়াকারী ব্যক্তি নির্দিষ্ট শতকরা হারে একটি কমিশন পেয়ে থাকে।
পুলিশের বক্তব্য : আইপিএল জুয়া নিয়ে উপ–কমিশনার (উত্তর) আব্দুল ওয়ারিশের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ক্রিকেট জুয়া সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। চেষ্টা করছি এই জুয়ার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণের। অনেককে আমরা ধরছি, সতর্ক করে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দিচ্ছি। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সে কিন্তু ছাড় পাবে না। তিনি আরও বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টহল পুলিশের নজরদারি আরও বাড়ানো হবে। এ ব্যাপারে তাদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। প্রয়োজনে পুলিশ কঠোরভাবে আইপিএল জুয়া দমন করবে।
বর্তমান সময়ে খেলাধুলা মানেই বাজি ধরাধরি। বিপিএল, আইপিএল, ফুটবলসহ প্রায় সব ধরণের খেলাতেই বিভিন্ন ধরণের বাজি চলে। কখনও টাকা আসে, কখন চলে যায়। এতে করে সে একটা অন্যরকম আনন্দ পায়। এ ক্রিকেট জুয়া মানুষকে ইয়াবার মত আসক্ত করছে। উঠতি বয়সের যুবক থেকে শুরু করে সেলুনের নাপিত, বিভিন্ন শ্রমজীবী, হোটেলের মেসিয়ার, টমটমের ড্রাইভারসহ স্কুল কলেজের ছাত্ররাও জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে এলাকায় আইন শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হচ্ছে। এলাকায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানির মত বিভিন্ন ধরনের অসমাজিক কর্মকা– বৃদ্ধি পাচ্ছে। জুয়ার টাকা দিতে না পারায় ঘটেছে আত্মহত্যার ঘটনাও। টাকার অভাবে কেউ কেউ দামি মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, মোটরসাইকেল, মায়ের/স্ত্রীর সোনার গহনাসহ নানা দামি জিনিসপত্র বন্ধকও রাখছে। এরপরও এসব বিষয়ে বিষয়ে অনেকটাই নীরব রয়েছে প্রশাসন। সচেতন মহল ভারতের আইপিএলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা উক্ত জুয়ার আসর বন্ধ করার জন্য প্রসাশনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। পূর্বকোণ

পাঠকের মতামত: