ঢাকা,বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ডিম হালদায়

চট্রগ্রাম প্রতিনিধি ::

বহু বছর পর গতকাল মুখে হাসি ফুটেছে হালদায় মা মাছের ডিম সংগ্রহকারী মৎস্যজীবীদের মুখে। গত বৃহস্পতিবার রাতে দেশের একমাত্র এই প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রে কার্প জাতীয় মা মাছ ডিম ছেড়েছে। গত ১০ বছরের মধ্যে হালদায় এবার সর্বোচ্চ পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ড. মনজুরুল কিবরিয়া। গতবার ডিম সংগ্রহ হয়েছিল ১ হাজার ৬৮০ কেজি। এবার সংগ্রহ হয়েছে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। ড. মনজুরুল কিবরিয়া জানান, কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে হালদায় মা মাছের ডিম ছাড়ার পরিবেশ এবার আগের চেয়ে ভালো। সেই ফলই এবার পাওয়া গেছে। হালদাকে দূষণের কবল থেকে মুক্ত করা সম্ভব হলে আবার আগের মত ডিম পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি। এবার ৪০৫টি নৌকায় ১ হাজার ২১৫ জন লোক নদীতে ডিম সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। প্রতি নৌকার লোকজন ১০ থেকে ১২ বালতি করে ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছেন।

গত বৃহস্পতিবার দুপুর দুটার দিকে নদীর বিভিন্ন স্থানে ভাটির সময় মা মাছ ডিমের নমুনা দেয়। এসময় আহরণকারীরা ডিম সংগ্রহের সরঞ্জাম নিয়ে নৌকা করে নদীতে অবস্থান নেন। নমুনা হিসাবে নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে ডিম ১ শ, দেড়শ ও ২শ গ্রাম ডিমের নমুনা সংগ্রহ করেন। এসময় তারা এক প্রকার নিশ্চিত হন যে, রাতে জোয়ারের সময় মা মাছ নদীতে ডিম ছাড়বে। তাই নৌকা ও ডিম আহরণের সরঞ্জাম নিয়ে তারা নদীতেই অপেক্ষা করতে থাকেন। নদীতে রাত জেগে সেই কাঙিক্ষত ডিমের দেখা মেলে রাত আড়াইটার দিকে। তখন নদীতে ছিল জোয়ারের পানির স্রোত। উরকিরচর, দক্ষিণ মাদার্শ থেকে শুরু করে একেবারে গহিরার অঙ্কুরীঘোনা, হাটহাজারীর গড়দুয়ারা পর্যন্ত হালদার ১৫ কিলোমিটার এলাকা থেকে ডিম সংগ্রহ করা হয়। নদীতে ডিম আহরণের এই দৃশ্য দেখা গেছে গতকাল সকাল পর্যন্ত। সংগৃহীত ডিম হালদার দুইপাড়ে স্থাপিত ৬টি হ্যাচারিতে এর মধ্যে রেণু ফোটানোর উপযোগী করে তোলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, চোরা শিকারিদের উৎপাত আর পরিবেশ দূষণের কারণে রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলাজুড়ে থাকা এই নদীতে মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছিল। ফলে ডিম উৎপাদনও ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছিল। ২০১৪ সালের ১২ মে, ২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল, ২০১৬ সালে ১৯ মে এবং ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল হালদায় ডিম ছেড়েছিল মা মাছ। সরকারি হিসাবে ২০১২ সালে ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল প্রায় এক হাজার ছয়শ কেজি। ২০১৩ সালে তা কমে ৬২৪ কেজি এবং ২০১৪ সালে আরও কমে মাত্র পাঁচশ কেজিতে দাঁড়ায়।

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, গত ১০ বছরের মধ্যে এবার সব চেয়ে বেশি ডিম সংগৃহীত হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের সদৃচ্ছা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কঠোর নিদের্শনার কারণে ডলফিন ও মাছ রক্ষায় ড্রেজার চলাচল এবং বালি উত্তোলন বন্ধ করা, ইঞ্জিন চালিত নৌযান চলাচল বন্ধ করা, মা মাছ শিকার বন্ধে কঠোর নজরধারি, ভুজপুর ড্যাম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পানির উপযুক্ত প্রবাহ নিশ্চিত করা, সর্বোপরি স্পিডবোটের মাধ্যমে নদী পাহারার ব্যবস্থার কারণে নদীতে মাছের অবাধ বিচরণ বেড়েছে। বেড়েছে মা মাছের সংখ্যাও। এ কারণে এবার নদীতে বেশি ডিম ছেড়েছে মা মাছ। এ অবস্থা ধরে রাখা গেলে ভবিষ্যতে ডিম ছাড়ার পরিমাণ আরো বাড়বে। হালদা ফিরে পাবে তার আগের ঐতিহ্য।

তিনি জানান, আবহাওয়াসহ সব কিছু ঠিক থাকলে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম থেকে আনুমানিক ৩৭৮ কেজি রেণু তৈরি হবে। এক কেজি রেণুতে চার–পাঁচ লাখ পোনা হবে। পরিমাণমতো পানিসহ এক কেজি রেণু গত বছর সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা বিক্রি হয়েছিল। এরপর পোনাগুলো কেজি দরে বিক্রি হবে। যত বড় হবে তখন সেগুলো প্রতিশ’, প্রতিটি হিসেবে বিক্রি হবে। সব মিলে অর্থনীতিতে কয়েক হাজার কোটি টাকার জোগান আসে হালদার মাছের ডিম থেকে। উল্লেখ্য, সাধারণত বর্ষা মৌসুমের শুরুতে পূর্ণিমা–অমাবস্যা তিথিতে পাহাড়ি ঢলের পানির সঙ্গে বজ্রসহ প্রবল বর্ষণ হলে এবং নদীর পানির তাপমাত্রা অনুকূলে থাকলে মা মাছ ডিম দেয়। হালদায় মূলত রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ জাতীয় মাছই ডিম ছাড়ে।

গতকাল কাগতিয়ায় মৎস্য বিভাগের প্রতিষ্ঠিত হ্যাচারী এলাকায় দেখা গেছে, ুইচ গেইটের সাথে মাটি কুয়ায় ডিম রেখে পোনা রূপান্তরের কাজে ব্যস্ত কয়েকজন ডিম আহরণকারীকে। এ সময় রুশ্মি ও ফোরকান নামে দুজন জানান, এবার সকলেই কাঙিক্ষত ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছেন। কিন্তু সরকারি হ্যাচারিটি নিয়ে তাদের অভিযোগ আছে। দেখা গেছে এই হ্যাচারিতে ডিম থেকে পোনা উৎপাদনের জন্য ৩০টি ট্যাঙ্ক আছে। এর মধ্যে দুটি ট্যাঙ্ক কোনো রকমে সংস্কার করে সেখানে ছুটু বড়ুয়া নামে এক মৎস্যজীবী পোনা তৈরীর কাজ করছেন। তিনি জানান, এত বড় হ্যাচারিটি ঠিক থাকলে অনেক ডিম সংগ্রহকারী এটি থেকে সুফল পেত। অনিরাপদ মাটির কুয়ায় ডিম রেখে ঝুঁকির মধ্যে ডিম ফুটাতে হতো না। আজিমের ঘাট ও ডোমখালী এলাকায় দেখা গেছে সংগ্রহ করা ডিম নিয়ে অনেকেই বিপাকে পড়েছেন। আগে থেকে তৈরি করে রাখা কুয়া ডিম রাখার উপযোগী না থাকায় অনেককেই দুপুর পর্যন্ত নৌকার মধ্যেই ডিম রাখতে হয়েছে। এলাকার মৎস্যজীবী মোহাম্মদ রোসাঙ্গির আলম বলেছেন, হালদার ঐতিহ্য ফিরে পেয়ে তারা খুবই খুশি।

পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন এর মাধ্যমে ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) এর সহকারি ভ্যালু চেইন ফ্যাসিলিটেটর সৈকত পাল ও বিশু চন্দ জানান, হালদা নদীর মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য আইডিএফ গৃহিত কর্মসূচির মাধ্যমে হালদা নদীতে মাছের অভয়ারণ্য সৃষ্টির জন্য এ প্রকল্প কাজ করছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার ৭ শ জন ডিম সংগ্রহকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ৫ শ থেকে সাড়ে ৫ শ লোক সরাসরি ডিম সংগ্রহের সাথে জড়িত। তাছাড়া নদীর মা মাছ রক্ষার জন্য হাটহাজারী অংশে ১৬ জন এবং রাউজান অংশে ১৫ জন এলাকা ভাগ করে পাহারাদার নিযুক্ত করা হয়েছে প্রকল্পের আওতায়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের মধ্যে ৪০ জনকে ডিম থেকে রেণু ফোটানোর জন্য ৪০ টি মাটির কুয়া স্থাপন করে দেওয়া হয়েছে। নদীর দুই পাড়ে প্রায় ২শ টি মাটির কুয়া রয়েছে।

পাঠকের মতামত: