ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

চকরিয়া বিদ্যুৎ অফিসের দূর্নীতি, এক ভুক্তভোগীর অসহায় কান্না! সমাধান আত্মহত্যায়!

ভুতুড়ে বিল নিয়ে এ কেমন পরামর্শ পিডিবির মিটার রিডারের, দুদকের গণশুনানিতে কাঁদলেন বহু গ্রাহক

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্রগ্রাম ::

পিডিবি চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ বিলে গরমিল, নতুন মিটার স্থাপন ও ট্রান্সফরমার সংস্কারে দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা অভিযোগ শুনলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ। গতকাল বুধবার সকালে নগরীর আগ্রাবাদস্থ পিডিবি প্রধান কার্যালয়ে দুদকের গণশুনানিতে ৩৮ জন গ্রাহক দুদক কমিশনারের কাছে এসব অভিযোগ করেন। বিদ্যুৎ বিলের গরমিলের সমাধান চাইতে যাওয়া এক গ্রাহককে পিডিবির মিটার রিডার ওমর ফারুক সমাধান না দিয়ে বিদ্যুৎ ভবনের ৪ তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করতে বলার অভিযোগে ঐ মিটার রিডারের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন দুদক কমিশনার। এছাড়া পিডিবির গ্রাহকদের সুবিধার্থে প্রতি শনিবার বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত চট্টগ্রামের ১২টি শাখা অফিসে শুনানি করারও নির্দেশ দেন। পাশাপাশি পিডিবির গ্রাহকদের সেবার মান বাড়াতে একটি হটলাইন নম্বর চালু এবং আসন্ন রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে পিডিবি কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেন দুদক কমিশনার।

গণশুনানি শেষে দুদক কমিশনার পিডিবি চট্টগ্রামের প্রদান প্রকৌশলীকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, বিদ্যুৎ বিলে গরমিলের বিষয়টি চোখে পড়ার মতো। এতে গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্ত ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এটার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। অভিযুক্ত ওমরের মতো স্টাফকে বিদ্যুৎ অফিস থেকে সরিয়ে নিতে হবে। যেই স্টাফ গ্রাহকের সমাধান না দিয়ে ৪ তলা থেকে লাফ দিতে বলেন, তিনি কোন ধরনের স্টাফ? তার বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন।

পিডিবির গণশুনানিকালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার ড. নাসির উদ্দিন আহমেদের কাছে নগরীর হালিশহরের নিউমুরিং এলাকার পিডিবির গ্রাহক মো. আবু বকর অভিযোগ করে বলেন, ‘পিডিবির নিউমুরিং অফিসের মিটার রিডার ওমর সাহেবকে আমি বললাম, আমার মিটার রিডিংয়ের সাথে বিলের ৩৪৫ ইউনিটের গরমিল আছে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এমন সমস্যা হচ্ছে। এটার সমাধান কী? জবাবে মিটার রিডার ওমর সাহেব আমাকে উত্তর দিলেন, ‘৪ তলা থেকে লাফ দেন, সমাধান হয়ে যাবে।’ উনার এই ধরনের আচরণ খুবই দুঃখজনক!

গ্রাহক আবু বকর তার দীর্ঘ অভিযোগে বলেন, বছরখানেক থেকে মিটারের রিডিংয়ের সাথে বিদ্যুৎ বিলের মিল থাকে না। বারবার বিদ্যুৎ বিল বেশি দেয়। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসের বিল নিয়ে আমি পিডিবির নিউমুরিং অফিসে যাই। বেশ কয়েকবার গিয়েও মিটার রিডার ওমর সাহেবকে পাইনি। পরে অফিস থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে ওনাকে ফোন দিই। বেশ কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেন নি। পরেরদিন আবার যখন ফোন করলাম, তখন ধরলেন। তিনি আমাকে অফিসে যেতে বললেন। পরে ১৪ মার্চ নিউমুরিং বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে ওনাকে পাইনি। পরে বাসায় গিয়ে ওমর সাহেবকে আবার ফোন দিই। তখন তিনি কী সমস্যা জানতে চাইলেন। বললাম নিউমুরিংয়ের এলাকার আতিয়া মহলের চারতলা ভবনের তিনতলার মিটার নিয়ে সমস্যা (৩ তলায় আমরা থাকি)। গতবারের মতো এই মাসেও বিল বেশি দিয়েছেন। আমি বেশ কয়েকবার আপনার অফিসে গিয়েছিলাম। আপনি এইটা একটু সমাধান করে দেন। তখন ওমর সাহেব বলে উঠলেন পরে দেখা যাবে। তখন আমি বলেছি একটু সমাধান করে দিলে ভালো হয়। বছরখানেক থেকে বিদ্যুতের বিলে অনেক টাকা বেশি দিতে হয়েছে।

শুধু নিউমুরিংয়ের আবু বকর নন, আগ্রাবাদের আবুল বাশারের মিটার রিডিংয়ের সাথে বিদ্যুৎ বিলের ৫ হাজার ইউনিটের গরমিল নিয়েও অভিযোগ করেন এই গ্রাহক। কালুরঘাটের সিরাজুল ইসলামের মিটারের সাথেও বিলের গরমিলের অভিযোগ শুনানিতে উত্থাপিত হয়।

গণশুনানিতে চকরিয়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের শমসের পাড়ার ছৈয়দ আলমের ছেলে মনসুর আলম মিন্টু অভিযোগ করে বলেন, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে চেকের মাধ্যমে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে এখনোও বিদ্যুৎ সংযোগ ও মিটার পাইনি। পরবর্তীতে আরও ৫০ হাজার টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় উল্টো আমার বৃদ্ধ বাবাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বিদ্যুৎ অফিস থেকে বের করে দিয়েছেন পিডিবির চকরিয়া উপজেলার আবাসিক ফয়জুল আলীম।

এসময় অভিযোগকারী বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে ছৈয়দ আলমের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের অ্যাকাউন্ড থেকে পিডিবি কর্মকর্তাকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেওয়া ও উত্তোলনে ব্যাংকের হিসাব বিবরণী কপি এবং সংশ্লিষ্ট কাজগপত্রও দুদক কমিশনারের হাতে দেন।

মনসুর আলম মিন্টু বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি বাবার (ছৈয়দ আলম) অ্যাকাউন্ড থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিই। টাকা নিয়ে এক বছর ধরে বিদ্যুৎ সংযোগ দিবে দিবে বলে কালক্ষেপন করতে থাকেন। পরবর্তীতে চলতি বছরের ৭ মার্চ আমার বাবা চকরিয়া বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে প্রকৌশলী ফয়জুল আলীমের কাছে সংযোগ দিতে দেরি হওয়ার কারণ জানতে চান। এসময় তাড়াতাড়ি সংযোগ পেতে হলে তিনি আরও ৫০ হাজার টাকা দাবি করলে বাবা রাজি হননি। তখন বাবা আগের টাকাগুলো ফেরত চান। তখন প্রকৌশলী ফয়জুল উল্টো বিদ্যুৎ অফিস থেকে আমার ৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ বাবাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন।

তিনি আরও বলেন, টাকা দেওয়ার বিষয়, বাবাকে গলা ধাক্কা দিয়ে অপমানের বিষয়গুলো স্থানীয় চেয়ারম্যানকে জানানো হলেও কোনো সুরাহা পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ২২ মার্চ চকরিয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পিডিবির প্রকৌশলী ফয়জুল আলীম, দেবানন্দ দত্তসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে আমার বাবা একটি ফৌজদারী মামলা দায়ের করেন। মামলার খবর পেয়ে পরদিন বিকেলের দিকে ফয়জুল সাহেবসহ আরও বেশ কয়েকজন আমাদের বাড়িতে গিয়ে বাবাকে আবারো অপমান করেন। এমনকি মামলা তুলে নিতে নানা ধরনের হুমকি দেন। তখন বাবা রাজি হননি। পরে বাড়ি থেকে ফিরে গিয়ে সরকারি কাজে বাঁধা দিয়েছে বলে বাবার বিরুদ্ধে মামলা করেন পিডিবির ওই প্রকৌশলী। এ মামলায় আমার বাবাকে থানায় ধরে নিয়ে যায়।

কান্না জড়িত কণ্ঠে মনসুর আলম মিন্টু আরও বলেন, আমার বৃদ্ধ বাবা এখনো জেলহাজতে। ওরা মিথ্যে মামলা দিয়ে বাবাকে জেল খাটাচ্ছে। সংযোগ পেতে টাকা দিয়ে হয়রানি কিনে নিয়েছি! আমি এর সু–বিচার চাই।

মনসুর আলম মিন্টু বিচার চেয়ে এক পর্যায়ে দুদক কমিশনারের পায়ে ধরে ফেলেন। এ সময় বাবাকে জেল থেকে ছাড়ানো এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও অনুরোধ জানান। এসব অভিযোগ শুনে দুদক কমিশনার দুঃখ প্রকাশ করেন এবং পিডিবি চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চান।

তখন প্রবীর কুমার সেন বলেন, চকরিয়ার বিষয়টি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তদন্ত করছে। তদন্ত রিপোর্ট পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দুদক কমিশনার ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদ্যুৎ উন্নয়নের চালিকা শক্তি। দুর্নীতি ও হয়রানি কোনো ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমরা এবার শুনানির ফলোআপ করতে এসেছি। এবারের পর আর কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যারা দুর্নীতির সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দুদককে জানান। দুদকের কাছে তাদের সম্পদের তথ্য দেন। আমরা তদন্তপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।

দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক মো. আকতার হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত বিব্রতকর। ওই আবাসিক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুদকে একটি আবেদন করেন। অভিযুক্ত প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও আশ্বাস দেন তিনি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের বিভাগীয় পরিচালক পরিচালক মো. আকতার হোসেনের পরিচালনায় গণশুনানি শুরু হয়। এতে পিডিবি চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেনসহ দুদুক ও পিডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

গণশুনানি চলাকালে পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী গ্রাহকদের বিভিন্ন সমস্যার কথা শুনেন এবং অবিলম্বে তা সমাধানের জন্য প্রত্যেক সাব স্টেশনের নির্বাহী প্রকৌশলীদের নির্দেশ দেন। এছাড়া গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা প্রদানে যে কোনো ধরনের ভোগান্তি লাঘবে চট্টগ্রাম মহানগরীর ১২টি নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরে প্রতি শনিবার গণশুনানি পরিচালনারও নির্দেশ দেন।

মূলত সারাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ–২০১৮ উদযাপনের অংশ হিসেবে মাঠ পর্যায়ে ‘বন্ধ হলে দুর্নীতি উন্নয়নে আসবে গতি’ শ্লোগান নিয়ে এবারের গণশুনানির আয়োজন করে দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম ও মহানগর দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি।

পাঠকের মতামত: