ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

মাদকে কাবু বহু তরুণ চট্টগ্রামে

অনলাইন ডেস্ক ::

চট্টগ্রামে হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনসহ বিদেশি মদ। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে তরুণ-তরুণীদের একটি বড় অংশ। তাদের সঙ্গে বেকার ও শ্রমিক পর্যায়ের অনেকে নিয়মিত মাদক গ্রহণের ফলে চট্টগ্রামের অবস্থাও খুব খারাপ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদক উদ্ধার অভিযানের চিত্র পর্যালোচনা করে এবং কয়েকটি আখড়া ঘুরে মাদকের আগ্রাসনের ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে।

গত সপ্তাহে তিন দিনে নগরীর বরিশাল কলোনি থেকে শুরু করে কয়েকটি অভিজাত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে মাদক গ্রহণের ভয়াল চিত্র। একই রকম চিত্র উঠে এসেছে নগর পুলিশের মাদক উদ্ধারের হিসাবে। ২০১৬ সালে নগর পুলিশ, র‌্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, এপিবিএন, বিজিবির অভিযানে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছিল ৯৬৭টি। সেখানে একই সংস্থাগুলো মাদক উদ্ধারের ঘটনায় গত বছর মামলা করেছে চার হাজার ২৬০টি। আগের বছরের চেয়ে এ সংখ্যা ৪.৪ শতাংশ বেশি।

মাদকের আখড়ায় সরেজমিন : মঙ্গলবার দুপুরে বরিশাল কলোনিতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে স্থানে স্থানে মাদকসেবীরা আড্ডা দিচ্ছে। নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক সন্তানকে দেখা গেল একটি ঝুপড়ি ঘরে। টিনশেডের ভেতরে বসে তারা মাদক সেবন করছিল। কয়েকজনের হাতে দেখা গেল ফেনসিডিলের বোতল, কয়েকজনের হাতে সিগারেট। আবার সিগারেটের রাংতা কাগজ দিয়ে নাকে ঘ্রাণ টানতেও দেখা গেল দুই-তিনজনকে। এদের পিঠে ব্যাকপ্যাক ছিল। বোঝা যায় তারা ছাত্র।

‘মাদকের হাটে’ যেতেই একজন জানতে চাইল, ‘কী লাগবে’? প্রশ্ন শুনে প্রতিবেদকের পাল্টা প্রশ্ন, ‘কী আছে?’—এমন প্রশ্ন শোনার জন্য মাদক বিক্রেতা যেন মোটেই প্রস্তুত ছিল না। কাচুমাচু কণ্ঠে বলল, ‘টাকা দেন, কী লাগবে বলেন, এনে দিই।’ দরদাম করার চেষ্টা করায় বিরক্ত প্রকাশ করে ওই বিক্রেতা অন্য দিকে চলে গেল। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মধ্য বয়স্ক লোক এ সময় মন্তব্য করল, ‘মনি, সবার কাছে জিজ্ঞেস করিস না।’

এই আস্তানা থেকে রেললাইনের বাঁক ধরে আরো কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখা মেলে কয়েকজনের। তারা গাঁজা সেবন করছিল। তাদের কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। একজন শুধু বললেন, ‘আপনি খাইলে বসেন, না খাইলে যান।’

বস্তির আখড়া থেকে রাতে নগরীর একটি অভিজাত হোটেলে গিয়ে দেখা গেল মাদক সেবনের উন্নত সংস্করণ। আগ্রাবাদ ব্যাংকপাড়া এলাকার ওই হোটেলের একটি কক্ষে কয়েকজন তরুণ সিসা টানছে। কয়েকজনের সামনে বিয়ারের ক্যান। নাশতা খাওয়া এবং বিয়ারের ক্যানে চুমুক দেওয়া এক সঙ্গেই চলছিল। আর সিসা টানার ধোঁয়ায় কক্ষটিতে নিঃশ্বাস নেওয়াই কঠিন লাগছিল।

মাদকের রুট : চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইয়াবা আসছে মিয়ানমার থেকে। সড়ক পথের চেয়ে বেশি আসছে জলপথে। ফেনসিডিল ও গাঁজা আসছে ভারতের সীমান্ত এলাকা থেকে। কুমিল্লা, আখাউড়া ছাড়াও ফেনী ও খাগড়াছড়ি সীমান্ত পার হয়েও চট্টগ্রামে আসছে ফেনসিডিল। আর বিদেশি মদ ও বিয়ার আসছে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজে করে। বহির্নোঙরে থাকা অনেক জাহাজ থেকে মাদক পাচারকারীরা কৌশলে বিদেশি মদ ও বিয়ার চট্টগ্রামে আনছে। আর দেশীয় মদ আসছে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে।

মাদক পাচারের এসব রুটের তথ্য জানিয়ে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপকমিশনার (পশ্চিম) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ  বলেন, ‘পুলিশ মাদক উদ্ধারের সর্বাত্মক অভিযান চালাচ্ছে বলেই বড় চালানগুলো ধরা পড়ছে। পুলিশের মাদক উদ্ধারের সাফল্য অতীতের চেয়ে এখন বেশি।’

পুলিশি চিত্র পর্যালোচনা : চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ২০১৭ সালের মাদক উদ্ধার চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে সিএমপিতে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছিল ৯৬৭টি। কিন্তু ২০১৭ সালে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে চার হাজার ২৬০টি। এসব মামলায় পুলিশ পাঁচ হাজার ৩০৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্ধারকৃত মাদকের মধ্যে চোলাই মদ ৩৪ হাজার ২৯৯ লিটার, গাঁজা এক হাজার ৭৮৪ কেজি, ইয়াবা ৭৭ লাখ ৭৯ হাজার ৮০৫টি, ফেনসিডিল ৯ হাজার ৯৪২ বোতল ও হেরোইন ৯০৪ গ্রামসহ অন্যান্য মাদক রয়েছে। যার মূল্য প্রায় ২১৮ কোটি টাকা।

সর্বাধিক তিন হাজার ৯৩৫টি মাদক উদ্ধার মামলা করেছে নগর পুলিশ। সিএমপির উদ্ধারকৃত মাদক ৫৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকার। সবেচেয়ে বেশি মাদক উদ্ধার করেছে র‌্যাব-৭। নগরীর থানাগুলোতে র‌্যাব মাদক উদ্ধারের ঘটনায় মামলা করেছে ৪২টি। মাদক উদ্ধারের পরিমাণ প্রায় ১৫১ কোটি টাকা।

সামাজিক প্রতিরোধ চাই : মাদক উদ্ধারের চিত্র পর্যালোচনা করে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কুসুম দেওয়ান বলেন, ‘২০১৬ সালে চেয়ে ২০১৭ সালে মাদক উদ্ধার বেশি হয়েছে, আসামিও বেশি গ্রেপ্তার হয়েছে। এটা পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানের সুফল।’ তিনি বলেন, ‘বরিশাল কলোনিসহ নগরীর মাদকের আখড়াগুলোতে পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। অনেক আখড়া গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাদকসেবীরাও আর বসে নেই। তারা নতুন নতুন আখড়া করছে। আর যেখানেই আখড়ার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।’ মাদকের সরবরাহ বাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পাচারকারীরা নিত্যনতুন কৌশলের মাধ্যমে পাচার করছে। তাই সরবরাহ কিছুটা বাড়তে পারে, তবে পাচারকারীরা খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না। কারণ পুলিশের হাতে ইতিমধ্যে মাদক পাচারের অনেক কৌশল ধরা পড়েছে। সঙ্গে মাদকও ধরা পড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান দিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ। মাদক নিয়ন্ত্রণে সামাজিক প্রতিরোধ জোরদার করতে হবে।’কালের কণ্ঠ

পাঠকের মতামত: