ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

চন্দনপুরা জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত শতবর্ষী নাচঘর

নিউজ ডেস্ক ::

ঘুঙুরের আওয়াজ নেই। নেই কোনো সুরের মূর্ছনা। আলোর ঝলকানি। অভিজাত লোকজনের কোনো পদচিহ্নও চোখে পড়ে না। নেই কোনো জমিদারি জৌলুসও। কিংবা পাইক পেয়াদার ব্যস্ত চলাচল। দোতলা ভবনের দরজা জানালার আস্তরণ সব খসে পড়েছে। কিন্তু বিশাল ভবনটি বেশ শক্ত–পোক্তভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। সেই ভবনে এখন আছে শুধু একরাশ হাহাকার। এরপরেও ‘হরোর’ ছবির সেই পরিত্যক্ত ভবনের মতোই এ ভবনেরও রয়েছে দারুণ দাপট। কারণ জনশূন্য এই ভবনে এখনো রাত–বিরেতে কেউ পা মাড়ানোর বা প্রবেশের সাহস করেন না। গা ছমছম করে। তাদের কানে ভেসে আসে রহস্যময় শব্দ ও ঘুঙুরের আওয়াজ। আশেপাশের লোকজনের কাছ থেকে শোনা যায় এসব কথা।
যে ভবনটিকে ঘিরে এতসব জনশ্রুতি সেটি হলো নগরীর চন্দনপুরায় অবস্থিত জমিদার বাড়ির নাচঘর। নবাব সিরাজুদ্দৌলা সড়কের পাশে, চন্দনপুরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সীমানায় এই ভবন। জমিদার সাজ্জালেলার জমিদারবাড়ির নাচঘর হিসেবে পরিচিত। প্রায় ২৫০ বছর পুরনো এ ভবনটি এখন পরিত্যক্ত। একসময়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় অগ্নিনির্বাপক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এখন এটি প্রস্তাবিত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরের চন্দনপুরা এলাকায় দাদা ও বাবার পর জমিদারি লাভ করেন জমিদার সাজ্জালেলা। জমিদার সাজ্জালেলার দাদার আমলে এই জমিদার বাড়িটি নির্মিত হয়। ব্রিটিশ আমলে সাজ্জালেলার মৃত্যুর পর তাঁর পুরো

পরিবার ভারতে চলে যায়।
অপরদিকে, পাকিস্তান সরকার হিন্দু জমিদারদের জায়গা–জমি অধিগ্রহণ করে নেয়। তার ধারাবাহিকতায় সাজ্জালেলার পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া এই বাড়িটিও সরকারি সম্পত্তিতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে সাজ্জালেলার পরিবারের লোকজন ভবনসহ পাশের জমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেও সফল হয়নি। পাকিস্তান সরকার এখানে চট্টগ্রাম বিভাগীয় অগ্নিনির্বাপক কার্যালয় স্থাপন করে। পরবর্তীকালে নগরের চৌমুহনী এলাকায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় অগ্নিনির্বাপক কার্যালয় নির্মিত হলে এটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ২৫ বছর আগে সরকার এই ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে।
চন্দনপুরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের পাশেই জমিদার সাজ্জালেলার জমিদারবাড়ির নাচঘর। বাইরে থেকে ভবনটির চাকচিক্যের কোনো কমতি নেই। শক্ত ইটের গাঁথুনির দোতলা ভবন। নানা কারুকাজ শোভিত। দেয়ালে দেব–দেবী আর ফুলের ছবি। চারপাশের দরজা–জানালা গুলোর কপাট ভাঙা, জীর্ণ দশা। দু’একটি কোনোভাবে শুধু গায়ে গায়ে লেগে আছে। ছাদের ওপরে আগাছা–পরগাছা জন্মেছে, রয়েছে ডালপালাসহ বড় বনজ গাছ। ভবনের নিচে একটি ফলকে লেখা রয়েছে ‘প্রস্তাবিত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স যাদুঘর। প্রাক্তন বিভাগীয় সদর দপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগ, চট্টগ্রাম।’ বছর দুয়েক আগে ফলকটি স্থাপন করা হয়েছে বলে জানালেন চন্দপুরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের স্টেশন অফিসার সাইফুল ইসলাম।
ভবনের সামনের অংশে শীতের বেশ দৃষ্টিনন্দন গাঁদাফুল ফুটে আছে। দোতলায় উঠে ওপরের কক্ষগুলো দেখার আগ্রহের কথা জানালে স্টেশন অফিসার ইতস্তত করলেন। ওপরের কক্ষগুলোতে যাওয়ার সাহস হয়নি কখনো। শুনেছেন ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথাও। এমনই আভাস মিললো তাঁর অভিব্যক্তিতে। অনেকটা অভয় দিয়ে আমার সঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দিলেও তিনি বললেন, ‘যেতে পারবেন না। সিঁড়ি নেই তো।’ তাঁরা বিভিন্ন সময়ে নানা প্রয়োজনে একতলা থেকে সরাসরি ছাদে ওঠেছেন নিচে কৃত্রিম সিঁড়ি টাঙিয়ে। এত কথার পরেও সিঁড়িপথে পা বাড়ালাম। দেখলাম, নিচ থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির কোনো অস্তিত্ব নেই আর। ভেঙে গেছে। শুধু কঙ্কালসার সিঁড়ির অবয়বটাই আছে। দেখেই বুঝা যায়, সিঁড়ির ধাপগুলো একে একে ধসে পড়েছে। এখন ফাঁকা সিঁড়িঘরের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেয়াল ঘেঁষে নেমে এসেছে গাছের শেকড়–বাকড়। নিচ থেকে ওপরে চোখ ঘুরিয়ে দেখা যায়, দোতলায় ঢোকার প্রবেশপথটি। আর একতলা থেকে দোতলায় সিঁড়ি বেয়ে ওঠার দুটি ধাপে রয়েছে জানালার মতো ছোট ছোট দুটি খোপ। স্পষ্টভাবে চোখে ধরা পড়ে। ভেতরে ঢোকার অনেকগুলো পথ। নিচের কয়েকটি কক্ষে তালা ঝুলছে। এগুলোও ফাঁকা বলে জানান ফায়ার স্টেশনের অফিসার সাইফুল ইসলাম।
জানা গেছে, এটি জমিদার বাড়ি হলেও আসলে জমিদার সাজ্জালেলার নাচঘর হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। এখানে বাঈজীদের জন্য আলাদা সাজঘর রয়েছে। দোতলা ভবনে অতিথি কক্ষসহ রয়েছে ১৪টি কক্ষ। নাচঘরের চারদিকে ১০টি দরজা দিয়ে প্রবেশ করা যায়। ওপরে ওঠার জন্য ভবনের এক কোণে একটিমাত্র সিঁড়ির ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে।

পাঠকের মতামত: