ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

আজ থেকে শুরু কক্সবাজার রেললাইনের নির্মাণ কাজ

কক্সবাজার প্রতিনিধি ::
অবশেষে বাস্তবায়নের চাকা ঘুরল বহু কাঙ্খিত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের। জেলা প্রশাসন থেকে জমির মালিকানা পাওয়ায় আজ থেকেই দৃশ্যমান নির্মাণ কাজ শুরু করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সুষ্ঠুভাবে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে আগামী ২০২০ সালেই স্বপ্নের রেল আসবে পর্যটননগরীতে।

জানা গেছে, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৩৭৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এরমধ্যে কক্সবাজারের চকরিয়া, রামু ও সদর উপজেলায় পড়েছে ৭২ কিলোমিটার। এই তিন উপজেলার ৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে ১ হাজার ৭৩ একর জমি। এরমধ্যে সদর উপজেলায় অধিগ্রহণ করা হয় ২১০ একর জমি। ওই ২১০ একর জমি গতকাল সোমবার সকালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।

সদর উপজেলার জমি হস্তান্তর উপলক্ষ্যে বাসটার্মিনাল সংলগ্ন বিএসডিসি খামারের পাশে প্রস্তাবিত রেলওয়ে ষ্টেশন এলাকায় এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প পরিচালক মো. মুফিজুর রহমানের কাছে জমির মালিকানা হস্তান্তর করেন জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন। জমি হস্তান্তর চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন জেলা প্রশাসকের পক্ষে ভুমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত হোসেন ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের পক্ষে উপপ্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কাজী আব্দুর রহমান, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নোমান হোসেন প্রিন্স ও ঝিলংজা ইউপি চেয়ারম্যান টিপু সুলতান।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, রেলপথ নির্মাণ কাজ শুরু করার জন্য সবকিছুই প্রস্তুত। কিন্তু জমির মালিকানা না পাওয়ায় এতদিন কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। জেলা প্রশাসন থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সদরের ২১০ একর জমির মালিকানা বুঝে পাওয়ায় আজ থেকেই রেলপথ নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
জেলা প্রশাসনের ভুমি অধিগ্রহণ শাখা সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলার ছয়টি মৌজা থেকে ২১০ দশমিক ৪২৬০ একর জমি রেলপথ নির্মাণের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। এরমধ্যে ঝিলংজা মৌজায় ৮৭ দশমিক ৬১০০ একর, মাছুয়াখালী মৌজায় ২০ দশমিক ৫৫১০ একর, ঈদগাঁও মৌজায় ৬৩ দশমিক ৮০৩৯ একর, নাপিতখালী মৌজায় ৩৩ দশমিক ২১৮১ একর, বোয়ালখালী মৌজায় ৩ দশমিক ৯১৩০ একর ও চৌফলদ-ী মৌজায় ১ দশমিক ৩৩০০ একর অধিগ্রহণ করা হয়। সদরের অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয় ৮৮৪ কোটি ৫৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এই জমিটুকু গতকাল রেলওয়েকে হস্তান্তর করা হয়। এছাড়া রামু ও চকরিয়া উপজেলার অধিগ্রহণকৃত জমিটুকুও শিগগিরই রেলওয়েকে হস্তান্তর করা হবে বলে জানা গেছে।

নতুন নিয়ম অনুযায়ী রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে মৌজা দামের দেড়গুণ টাকা দেওয়া হচ্ছে। গতকাল সোমবার থেকে সদরের অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের চেক বিতরণ কার্যক্রমও শুরু হয়। প্রথমদিনে লালন দত্ত ও উক্যথিং রাখাইন নামে দু’জন জমির মালিকের হাতে দুটি চেক তুলে দেন জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন। এরমধ্যে দুলাল দত্তের চেকের পরিমাণ ২৫ লাখ ও উক্যথিং রাখাইনের চেকের পরিমাণ ৩১ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। হয়রানি ছাড়াই ক্ষতিপূরণের চেক পাওয়ায় সন্তুষ্ট এ দুই জমির মালিক।

চেক বিতরণ শেষে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের উদ্দেশ্যে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের ভুমি অধিগ্রহণ শাখায় নির্ধারিত নিয়মে ফরম পূরণ করে আবেদন করবেন। দ্রুত সময়ে যাচাই বাচাই শেষে ক্ষতিপূরণের চেক আপনার হাতে পৌছে যাবে। এরজন্য তৃতীয় কোন পক্ষের সাথে যোগাযোগ করার প্রয়োজন নেই। কারণ অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে একটি দালাল চক্র সক্রিয়। তারা হয়রানিতে ফেলতে তৎপর।’

তিনি আরও বলেন, ‘জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে কোন ধরণের চেক দেওয়া হবে না। সব চেক প্রকল্প স্থানে সরাসরি হস্তান্তর করা হবে। আর কেউ অক্ষম হলে তাঁর চেক বাড়িতে গিয়ে পৌছে দেওয়া হবে। তিনি শোনেছেন, ৩০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণের চেক পেতে ৩০ শতাংশ কমিশন নিয়ে নেয় একটি চক্র। এই ধরণের চক্রের কাছ থেকে সাবধান থাকার পরামর্শ দেন তিনি। আর এধরণের কোন দালালের সন্ধান পেলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে দেওয়ার অনুরোধ জানান। এক্ষেত্রে তিনি সব ধরণের সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন।’

সূত্রমতে, ২০১০ সালে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঝিলংজা বিএডিসি খামার এলাকায় রেলপথ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন করেন। এ প্রকল্পটি শুরুতে সিঙ্গেল মিটার গেজ হিসেবে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে মিটার গেজের পরির্বতে ডুয়েল গেজ নির্মাণের নির্দেশনা দেন। পরে ২০১৬ সালে সেটি অনুমোদন পায়। এরফলে ব্যয়ও বাড়ে বহুগুণ। দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকলেও গত এক বছর থেকে এই প্রকল্পের দ্রুত অগ্রগতি হয়। যা আজ থেকে দৃশ্যমান বাস্তবায়ন কাজ শুরু হচ্ছে।

জানা গেছে, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে বাস্তবায়িত পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। তবে রেলপথ নির্মাণের জন্য প্রথম লট দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত চুক্তির মূল্য ২ হাজার ৬৮৭ কোটি ৯৯ লাখ ৩৪ হাজার টাকা এবং দ্বিতীয় লট চকরিয়া রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ৩ হাজার ৫০২ কোটি ৫ লাখ ২ হাজার টাকা। অর্থাৎ চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ চুক্তির মূল্য ৬ হাজার ১৯০ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। তবে এ প্রকল্পের রামু থেকে মিয়ানমারের ঘুমধুম সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ আপাতত হচ্ছে না। শুধু চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ ও অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। এছাড়াও রামু থেকে মিয়ানমারের ঘুমধুম সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ কার্যক্রম প্রক্রিয়াও শিগগিরই শুরু হবে। আর এটি নির্মিত হচ্ছে চীন ও বাংলাদেশের যৌথ কারিগরি সহায়তায়।

আজ (মঙ্গলবার) থেকেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজ শুরু করার কথা জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান বলেন, এ রেলপথের উদ্দেশ্য পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা। পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরী করা।

তিনি আরও বলেন, প্রকল্পে কক্সবাজারে বিএডিসি খামার সংলগ্ন প্রস্তাবিত এলাকায় ঝিনুকের আদলে তৈরি করা হবে নান্দনিক একটি রেলওয়ে টার্মিনাল। টার্মিনালটি ঘিরে গড়ে উঠবে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় হোটেল, বাণিজ্যিক ভবন, বিপণিবিতান, বহুতলবিশিষ্ট আবাসিক ভবনসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্প। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থাপনাগুলোর নকশাও চূড়ান্ত করা হয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে রেলপথটি ইরান থেকে শুরু করে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও চীনের রেলওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। পরে যশোর, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা হয়ে ভারত যাবে। আর তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে তৈরি হবে ২৭টি দেশের রেল নেটওয়ার্ক। গড়ে উঠবে সহজ আঞ্চলিক রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা।

কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির আইনবিভাগের চেয়ারম্যান ড. নায়ীম আলীমুল হায়দার বলেন, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপন সম্পন্ন হলে পর্যটন খাতে আমূল পরিবর্তন আসবে, বাড়বে রাজস্ব আয়ও। তবে এটি বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে যেন কেউ অহেতুক হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে।

কক্সবাজার পিপল্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল বলেন, এ রেলপথ আরও অনেক আগেই হওয়া প্রয়োজন ছিল। আমরাও চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি বাস্তবায়িত হোক। এটি সম্পন্ন হলে কক্সবাজারে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বহুগুণ বাড়বে।

পাঠকের মতামত: