ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

চট্টগ্রামের পথে পথে গণপরিবহনে চাঁদাবাজি

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্রগ্রাম ::

চট্টগ্রাম মহানগরের গণপরিবহনব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। বৈধ-অবৈধ মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলার ও টেম্পো থেকে প্রতিদিন সাত থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সে হিসাবে মাসে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। ‘ওয়েবিল-এর (গাড়ি চলাচলের জন্য ফি) নামে নগরের পথে পথে এই চাঁদাবাজি চললেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন নীরব।

পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, ওয়ান-ইলেভেনের পর গণপরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে ‘ওয়েবিল’ প্রথা বন্ধ করা হয়েছিল। তখন সব মালিক সংগঠন ভেঙে একটি ফোরামে নিয়ে আসা হয়। ওই সময় নগর গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধের পাশাপশি প্রথমবারের মতো রুট নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর পর নগর গণপরিবহনে আবার বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এখন তা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অনেক রুটের অনুমোদন নেই। কিন্তু প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে এসব রুটে গাড়ি চলছে।
সরকার নির্ধারিত হারের বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া কোন রুটে কয়টি গাড়ি চলাচল করবে তা নির্ধারিত থাকলেও এটি অনেকে মানছে না। এক রুটের অনুমোদন নিয়ে অন্য রুটে গাড়ি চালাচ্ছে মালিক সংগঠনগুলো।

ভুক্তভোগী যাত্রীরা অভিযোগ করছে, যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো এবং প্রায় রুটে কাউন্টারভিত্তিক সার্ভিস না থাকা, অনেক গাড়ি অফিসে আসা-যাওয়ার সময় (পিক আওয়ার) বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভাড়ায় চালানোসহ নানা কারণে গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা চলছে।

পরিবহন খাতের লোকজনের কাছ থেকে জানা গেছে, নগর গণপরিবহন এখন দুই ভাগে বিভক্ত। দুপক্ষই নিয়ন্ত্রণ করছেন ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। সমপ্রতি নগর পরিবহনের একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ওই দুই সংগঠন মুখোমুখি অবস্থানে ছিল।

চট্টগ্রাম মেট্রো গণপরিবহন মালিক সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবিতে গত ৩ ডিসেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের গণপরিবহন ধর্মঘট শুরু করেছিল। ওই ধর্মঘট প্রত্যাখ্যান করে গাড়ি চালিয়েছিল চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন নগরের গণপরিবহন মালিক সংগঠনগুলো। ওই ধর্মঘটের তিন দিনে এসে গত ৫ ডিসেম্বর মেয়রের আশ্বাসে মালিক সংগ্রাম পরিষদ অনির্দিষ্টকালের গণপরিবহন ধর্মঘট স্থগিত করে।

মালিক সংগঠনগুলোর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতা জানান, ওই মালিক সংগঠনের দ্বন্দ্ব সাধারণ পরিবহন মালিক শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে নয়। দুই পক্ষই নগর গণপরিবহন একক নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন থেকে মালিক সংগঠনগুলো কে বেশি সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে পারে তা নিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো একপক্ষ অন্যপক্ষের চাঁদাবাজির পাশাপাশি বিশৃঙ্খলার বিষয়টি আলাদাভাবে প্রশাসনকে তুলে ধরছে।

ওই নেতারা জানান, মালিক সংগঠনগুলোর বিরোধ মূলত একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তা ছাড়া গাড়িপ্রতি চাঁদাবাজির হার আরো কিভাবে বাড়ানো যাবে তার চেষ্টা চলছে।

গণপরিবহন মালিক সংগঠনগুলোর দৈনিক চাঁদাবাজিতে সাধারণ বাস-মিনিবাস, হিউম্যান হলার ও টেম্পো মালিক-চালকদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, বন্দরনগর চট্টগ্রামে বাস-মিনিবাসের ১৪টি রুট রয়েছে। এসব রুটে এক হাজার ১৩৪টি বাস-মিনিবাস চলাচল করছে। এ ছাড়া ১৬টি হিউম্যান হলারের রুটে এক হাজার ২৫০টি এবং ১৬টি টেম্পো রুটে এক হাজার ৬৬২টি গাড়ি চলছে।

মালিক সংগঠনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতারা জানান, বিআরটিএর এই হিসাবের বাইরে আরো কয়েক শ গণপরিবহন চলাচল করছে প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়াই।

গত কিছুদিন নগরের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে বাস-মিনিবাস, হিউম্যান হলার ও টেম্পো চালক-মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘ওয়েবিল’-এর নামে প্রতিদিন বাস-মিনিবাসের বেশির ভাগ রুটে গাড়িপ্রতি ১১০ থেকে ২৮০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো রুটে নেওয়া হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। চলাচলকারী বাস-মিনিবাস থেকে মালিক সংগঠনগুলো গাড়িপ্রতি দৈনিক গড়ে ২৫০ টাকা হিসাবে এক হাজার ১৩৪টি থেকে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৫০০ টাকা, চার চাকার হিউম্যান হলারগুলো থেকে গড়ে ১০০ টাকা হিসাবে এক হাজার ২৫০টি থেকে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করছে।

নগরের নিউ মার্কেট থেকে হাটহাজারী, চকবাজার থেকে বারিক বিল্ডিং, ইপিজেড মোড় থেকে এয়ারপোর্ট, আগ্রাবাদ থেকে বড়পোলসহ বেশ কয়েকটি অবৈধ রুটে আরো অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ বাস-মিনিবাস, হিউম্যান হলার ও টেম্পো চলছে। এসব গাড়িপ্রতি ১০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। ৪৫০ গাড়ি হিসাবে দৈনিক ২০০ টাকা করে ৯০ হাজার টাকা নিচ্ছে মালিক সংগঠনগুলো। শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও স্বীকার করেছেন তাঁদের নিয়ন্ত্রিত সংগঠনগুলো বাস-মিনিবাস ও হিউম্যান হলারচালক থেকে গাড়িপ্রতি দৈনিক ২০ টাকা এবং টেম্পোচালক থেকে ১০ টাকা করে নিচ্ছে। সেই হিসাবে এক হাজার ১৩৪ বাস-মিনিবাস, এক হাজার ২৫০ হিউম্যান হলার এবং এক হাজার ৬৬২ টেম্পো থেকে শ্রমিক সংগঠনগুলো দৈনিক ৪১ হাজার ৬২০ টাকা চাঁদা আদায় করে। তবে চালক ও সহকারীরা বলছে, কোনো কোনো রুটে টাকা আরো বেশি নেওয়া হচ্ছে।

একাধিক মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা নাম প্রকাশ না করে বলেন, বেশির ভাগ সংগঠন নিয়মিত অডিট করে না। তাই দৈনিক কত চাঁদাবাজি হয় এর প্রকৃত কোনো তথ্য কারো কাছে থাকবে না। তাঁদের হিসাবে নগর গণপরিবহনে দৈনিক ৭-১০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। সেই হিসাবে মাসে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। তবে কোনো মালিক সংগঠনের একক নিয়ন্ত্রণে এলে চাঁদাবাজি আরো বাড়বে বলে মনে করেন ওই নেতারা।

গণপরিবহনে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব বেলায়েত হোসেন বেলাল গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘আমাদের মালিক গ্রুপের আওতাধীন সাতটি মালিক সংগঠন আছে। বাস-মিনিবাস ও হিউম্যান হলার আছে এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৭০০টি। আমার জানা মতে, স্ব-স্ব মালিক সংগঠনগুলো দৈনিক গাড়িপ্রতি ওয়েবিল বাবদ ৭০-৮০ টাকা নিচ্ছে। গাড়ি চলাচলে শৃঙ্খলা, লাইনম্যানের খরচ, সমিতি অফিসসহ বিভিন্ন খাতে এসব টাকা ব্যয় হচ্ছে। ’

মহাসচিব দাবি করেন, ‘যেসব মালিক সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন নেই তারাই ট্রাফিক বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। ’ তবে তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু সংগঠনের চাঁদাবাজির কারণে নগর গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা ও চরম নৈরাজ্য হচ্ছে, এটা ঠিক। আমরা প্রশাসনের কাছে অনিয়ম ও চাঁদাবাজি বন্ধে বিভিন্ন সময় দাবি জানালেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, তা বলতে পারছি না। ’

বেলায়েত হোসেন বেলাল জানান, ওয়ান ইলেভেনের সময় মালিক সংগঠনগুলো ভেঙে দিয়ে সবার সমন্বয়ে মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক ফোরাম গঠন করা হয়েছিল।

চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু বলেন, ‘একসময় চট্টগ্রাম নগরে একটিমাত্র মালিক সমিতির অধীন গণপরিবহন চলত। এত সংগঠন আগে কখনো ছিল না। দেখা গেছে, ১০ থেকে ৩০টি গাড়ি দিয়েও একটি সমিতি করা হয়েছে। অনেক সমিতির যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেই। আমাদের হিসাবে বেশির ভাগ গাড়ি থেকে গড়ে দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। দিনে গণপরিবহন থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। এসব টাকার হিসাব নেই। ’

মঞ্জু দাবি করেন, ‘জেলার মালিক সংগঠনগুলোর নিয়মিত অডিট হলেও নগরের বেশির ভাগই হয় না। চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্যই একটি মালিক গ্রুপ বিভিন্ন দাবির আড়ালে ধর্মঘট করেছে। কিন্তু আমাদের সংগঠনের জন্য তা পারেনি। আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন মালিক সংগঠনগুলো গাড়ি চালিয়েছে। ’ ওয়াবিলের নামে যে চাঁদাবাজি হচ্ছে তা থেকে পুলিশের কেউ কেউ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা ভাগ পান বলে তিনি অভিযোগ করেন।

শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক অলি আহম্মদ বলেন, ‘নগরে আমাদের নিবন্ধিত ১৪টি শ্রমিক সংগঠন আছে। আমার জানা মতে, বাস-মিনিবাস ও হিউম্যান হলারপ্রতি আমাদের সদস্যদের কাছ থেকে জনপ্রতি ২০ টাকা এবং টেম্পো থেকে ১০ টাকা করে নেওয়া হয়। এর বাইরে নিচ্ছে কি না, তা আমি জানি না। দৈনিক তোলা টাকা শ্রমিকদের আপদ-বিপদে ব্যয় হয়। ’ অডিটও হয় বলে তিনি দাবি করেন।

পাঠকের মতামত: