ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

বিবেকহীন আয়োজন: কৈফিয়ত কে দেবে?

সুধীর দাসের (ছবিতে নেই) পরিবার জানত দুপুরে মেজবানের খাওয়া শেষে ঘরে ফিরবেন তিনি। বিকেল না হতেই তাঁদের জানানো হলো তিনি হাসপাতালের লাশঘরে রয়েছেন। সোমবার বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে -সৌরভ দাশ

প্রথম আলো :
সাবেক মেয়র যে চলে গেছেন, সেটাই যেন আরও পরিষ্কার হলো এই অবহেলা আর হেলাফেলার মৃত্যুতে। লাশের গুনতিতে এখন পর্যন্ত ১০ জনের নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে পুলিশ! আহত কত, তা নিয়ে বিভ্রান্তি এখনো কাটেনি; এঁদের মধ্যেও অনেকেই শঙ্কামুক্ত নন।

বাংলাদেশ দাওয়াত খেতে গিয়ে মানুষ মানুষের পায়ের তলায় পড়ে নিহত হওয়ার হয়তো কোনো অতীত ইতিহাস নেই; আমরা মরি ধনীকে বেহেশতের পাস দিতে গিয়ে—জাকাতের কাপড় নিয়ে তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ২০১৪ সালে বরিশালের কাঠপট্টিতে জাকাত সংগ্রহ করতে গিয়ে মানুষের পায়ের নিচে পড়ে দুজন গরিব নারী নিহত হলে তেমন শোরগোল শোনা যায়নি। তবে ২০১৫ সালের ১১ জুলাই ময়মনসিংহে এক নিমেষে চার শিশু আর ২৩ মায়ের প্রাণ চলে গেলে সবাই একটু নড়েচড়ে বসে। আয়োজকদের গ্রেপ্তার, তদন্ত, মামলা—এসব করে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। পুলিশ চোখ-কান খোলা রাখার চেষ্টায় নিয়োজিত হওয়ার অঙ্গীকার জানায়। তবে তার আগে সে বছরের মার্চ মাসে একটা সতর্কসংকেত এসেছিল, যখন অষ্টমীর স্নানে আগত পুণ্যার্থীদের ১০ জন পদদলিত হয়ে নিহত হন। ঢাকার কাছেই পুরাতন ব্রহ্মপুত্রপাড়ের এই মর্মান্তিক ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। আয়োজকদের টিকির নাগাল কেউ পায়নি বা পেতে চায়নি। পায়ের তলায় থাকা গরিব মানুষেরা পায়ে চাপেই তো মরবে—এই যেন আমাদের মনোভাব।

সব সময় যে কেবল গরিব মানুষেরা পায়ের নিচে পড়ে মারা যায়, তা বলা ঠিক হবে না। ২০১৫ সালের হজে ঠিক কত বাংলাদেশির প্রাণ গিয়েছিল, তা আর কোনো দিনও জানা যাবে না। যাঁরা হজে যান, তাঁরা কেউ গরিব মানুষের কোঠায় পড়েন না (বদলি হজে বাতিক্রম ছাড়া), তবু এই অবহেলা কেন? কারণ, দেশটা যে ধনী নয়! তাই আমাদের আওয়াজ থাকে অনেক নিচের স্তরে; তাই নিহত ব্যক্তিদের মধ্যেও শ্রেণিগত তফাত করে আয়োজকেরা। তা সে দেশ বা বিদেশ যেখানই হোক। অবসরে থাকা এক পুলিশ বন্ধু রেফারেন্স দিলেন, শুধু কি এখানে মরে, বিদেশেও মরে পায়ের নিচে। এই যে ভারতে মোদির কালেই তো মরল। বলা বাহুল্য, বন্ধুটি ২০১৫ সালে তেলেঙ্গানা আর অন্ধ্রের সীমানায় স্নানে আসা ২৭ পুণ্যার্থীর মৃত্যু আর এই বছরে মুম্বাই ফুটওভার ব্রিজ দুর্ঘটনায় ২২ জনের পদদলিত হয়ে নিহত হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। চাইলে তিনি ইতালির তুরিনে পায়ের তলায় পড়ে ফুটবলপ্রেমিকদের মৃত্যু কিংবা অ্যাঙ্গোলার স্টেডিয়ামে দর্শকদের প্রাণ হারানোর রেফারেন্স দিতে পারতেন। বলতে পারতেন, এই তো সেদিন (২০ নভেম্বর ২০১৭) মরক্কোতে ত্রাণের খাবার আনতে গিয়ে ১৫ জন পায়ের নিচে পড়ে মারা গেল। এর কোনোটাই মিথ্যা নয়। তবে সেই সঙ্গে এটাও মানতে হবে, ভারত, অ্যাঙ্গোলা, ইতালি—এমনকি রাজার শাসনের দেশ মরক্কোতে এসবের বিচার হয়। দোষী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে শাস্তি দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে আর যেন না ঘটে তার চেষ্টা থাকে।

যাঁরা মিসকিন খাওয়াবেন, মেজবান করবেন, জাকাত দেবেন বা থাকবেন কোনো ধর্মীয় সমাগমের সংগঠকের দায়িত্বে, জবাবদিহি তাঁদেরই করতে হবে। মানুষকে ডেকে দানবীর হতে গিয়ে যমদূত হয়ে যাওয়ার আগে তাঁদের ভাবতে হবে, যে আয়োজন করছেন, তা সামলানোর সামর্থ্য তাঁদের আছে কি না। যা পারবেন না, তা করতে যাবেন কেন? পুলিশ ও নগর কর্তৃপক্ষও কীভাবে তদারকি ছাড়া অনুমতি দেয়? শহর বা গ্রামে নিরীহ জনসমাগমও ভয়ানক গণবিধ্বংসী হতে পারে কেবল অবহেলা আর বিশৃঙ্খলার কারণে, একের পর এক পদদলিত হওয়ার ঘটনা তা জানিয়ে গেল।

আমাদের বরিশালের পর নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামে রেল চলে পদদলনের—হুইসিল বাজে, হুঁশ ফেরে না। এবার চট্টগ্রামেই থেমে যাক এই অবহেলা, এই আশাই করি।

পাঠকের মতামত: