ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

চা উৎপাদনে শীর্ষে ফটিকছড়ির ১৭ বাগান

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্রগ্রাম :

চট্টগ্রামের ২২টি চা বাগানে এক কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে রোদে পুড়ে–বৃষ্টিতে ভিজে চা শ্রমিক–কর্মচারী–ব্যবস্থাপকগণ কাজ করছেন। ইতোমধ্যে প্রায় ৯০ লক্ষ কেজি চা উৎপাদন করেছেন তারা। তৎমধ্যে ফটিকছড়ি উপজেলার ১৭টি চা বাগান রয়েছে শীর্ষ স্থানে। তারা উৎপাদন করেছে প্রায় ৮০ লক্ষ কেজি চা। যা এ যাবৎ কালের চা উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড অতিক্রম করা সাফল্য। আবার চট্টগ্রাম চা নিলাম কেন্দ্রে সর্বোচ্চ দরপ্রাপ্ত চা বাগান রয়েছে ফটিকছড়িতে। সারা দেশে চা উৎপাদনে ‘টপ টুয়েন্টি’ এবং এক মিলিয়িন কেজির বেশি চা উৎপাদনকারী বাগানের তালিকায়ও রয়েছে ফটিকছড়ির চা বাগান। তবে চা বাগানগুলোতে নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং গ্যাস সংযোগ পেলে উৎপাদন খরচ কমে চায়ের গুণগত মানের আরো উন্নতি হতো বলে দাবি করেছেন চা বাগান মালিক ও ব্যবস্থাপকগণ।

চট্টগ্রাম চা সংসদ এসোসিয়েশন সূত্র জানায়, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও অনুকূল আবহাওয়া চা উৎপাদনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতি বৃষ্টি আবার চা উৎপাদনের জন্য ক্ষতি। তবুও দেশে চলতি বছর চা উৎপাদন বেড়েছে। চা বাগানে সাধারণত বছরের শুরু এবং শেষ সময় ভালো মানের চা উৎপাদন হ্রাস পায়। তবে এবার তা অব্যাহত রয়েছে। উৎপাদন ভালো হওয়ায় পূর্বের চেয়ে বেশি চা সরবরাহ করছে ফটিকছড়ির বাগানগুলো। বৃহত্তর চট্টগ্রামের ২২টি চা বাগানে এক কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তন্মধ্যে ফটিকছড়ির ১৭টি চা বাগান ইতোমধ্যে প্রায় ৮০ লক্ষ কেজি চা উৎপাদন করেছে। আর বৃহত্তর চট্টগ্রামের অন্যান বাগানগুলো মিলে উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৯০ লক্ষ কেজি।

চট্টগ্রাম চা নিলাম কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাস পর্যন্ত সর্বোচ্চ দরপ্রাপ্ত চা বাগানের মধ্যে রয়েছে ফটিকছড়ির ব্র্যাক–কৈয়া ছড়া চা বাগান। তাদের উৎপাদিত চা ২৫৭ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এই তালিকায় কর্ণফুলী, নেপচুন, রাঙ্গাপানি, হালদা ভ্যালি, আছিয়া, উদালিয়াসহ ফটিকছড়ির বেশির ভাগ চা বাগান রয়েছে। এক মিলিয়ন কেজির বেশি চা উৎপাদনকারী বাগানের মধ্যে রয়েছে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্র্যাক–কর্ণফুলী চা বাগান।

রাঙ্গাপানি চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. শফিউল আলম মিলন জানান, ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৪ লক্ষ ২ হাজার ৫শ’ ৬০ কেজি এবং চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্ত ৪ লক্ষ ৮০ হাজার ১৪ কেজি চা উৎপাদন করেছেন তারা। যা বছর শেষে ৫ লক্ষ ৫০ হাজার কেজিতে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

নেপচুন চা বাগানের ব্যবস্থাপক কাজী এরফান উল্লাহ জানান, ২০১৬ সালে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই বাগানের উৎপাদন ছিল ৯ লক্ষ ৫২ হাজার কেজি। চলতি বছরে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এটি দাঁড়িয়েছে ১০ লক্ষ ১০ হাজার কেজি (প্রায়)। এ বছর আমরা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার একর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে প্রায় সাড়ে ১১ লক্ষ কেজি চা উৎপাদনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

পেড্রোলো গ্রুপের হালদা ভ্যালি ও রামগড় চা বাগানের আবাসিক ব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চলতি বছরের গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হালদা ভ্যালি বাগানে ৭ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। আর রামগড় চা বাগানে উৎপাদন হয়েছে ৬ লক্ষ ৮৫ হাজার কেজি। অতি বৃষ্টি চা উৎপাদনে কিছু ক্ষতি করলেও আমরা নিজস্ব সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে মৌসুমের শুরু এবং শেষ সময়ে সেচ দেয়ার কারণে দুই বাগানে বছর শেষে প্রায় ১৮ লক্ষ কেজি উৎপাদন করার সম্ভাবনা রয়েছে।

টি. কে গ্রুপের মালিকানাধীন বারমাসিয়া, এলাহী নূর ও রাঙ্গাপানি চা বাগানের আবাসিক ব্যবস্থাপক বাবুল বিশ্বাস জানান, ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তাদের তিনটি বাগানে উৎপাদিত চায়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩ লক্ষ কেজি। যা চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ছিল প্রায় ১৫ লক্ষ কেজি। এটি বছর শেষে প্রায় ২০ লক্ষ কেজিতে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতি বছর উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফটিকছড়ির ১৭টি বাগান নিরলসভাবে দেশের চা শিল্পকে উন্নত পর্যায়ে নিতে কাজ করছে। এখানে লক্ষ লক্ষ লোক কাজ করে। কিন্তু একটি মাত্র চা রিচার্জ কেন্দ্র রয়েছে। এটিও জনবল সংকটে ধুকছে। তাই সবাইকে সিলেটে দৌঁড়াতে হয়। চা বাগানের সড়কগুলোর খুবই করুণ অবস্থা। সরকার বিষয়গুলো গুরুত্ব দিলে শিল্পটি আরো অগ্রসর হবে।

এশিয়ার বৃহত্তম ব্র্যাক কর্ণফুলী চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই বাগানের উৎপাদন ছিল প্রায় ১৫ লক্ষ কেজি। চলতি বছরে এটি গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫ লক্ষ ৫০ হাজার কেজি। বছর শেষে এখানে প্রায় ৩ হাজার একর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে প্রায় ১৮ লক্ষ ১৬ হাজার কেজি চা উৎপাদন করা যাবে। তিনি আরো বলেন, সারা দেশে এক মিলিয়ন কেজির বেশি চা উৎপাদনকারী বাগানের মধ্যে আছে ব্র্যাকের মালিকানাধীন আমাদের তিনটি চা বাগান। আর চট্টগ্রামের মধ্যে ফটিকছড়ির চা বাগানগুলো ‘টপ টুয়েন্টি’ দখল করে আছে দীর্ঘদিন।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম চা সংসদের সভাপতি ও আছিয়া চা বাগানের প্রবীণ ব্যবস্থাপক মো. মমতাজ উদ্দিন মন্টু বলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রামের ২২টি বাগানে এ বছর আমরা এক কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে আমরা ৯০ লক্ষ কেজির বেশি চা উৎপাদন করেছি। পর্যাপ্ত বৃষ্টি চা উৎপাদনের জন্য উপযোগী হলেও এবছর অতিবৃষ্টি একটু ক্ষতি করেছে। আর পল্লী বিদ্যুতের সর্বোচ্চ বিল এবং নিয়মিত বিল পরিশোধকারী হচ্ছে চা বাগানগুলো। কিন্তু সে তুলনায় ফটিকছড়ির বিদ্যুৎ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। সিলেট অঞ্চলে চা বাগানগুলো গ্যাস সংযোগ পেয়েছে। তাদের প্রতি কেজি উৎপাদন খরচ পড়ে ২.৫০ পয়সা। আর আমাদের ডিজেল মেশিনে উৎপাদন খরচ পড়ে ৩৫ টাকার বেশি। তাই চা বাগানে গ্যাস সংযোগ পেলে আমরা চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ শিল্পে ব্যাপক চমক দেখাতে পারবো।

পেড্রোলো গ্রুপের চেয়ারম্যান (রামগড় ও হালদা ভ্যালির মালিক) লায়ন নাদের খান বলেন, চট্টগ্রামের বাগানগুলোতে উচ্চ ফলনশীল বিটি–২ জাতের চারা থেকে ভাল ফলন পাওয়া যাচ্ছে। তাই গত বছরের তুলনায় এবছর ৩০ শতাংশ চা বেশি উৎপাদন হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। সেমুতাং গ্যাস ফিল্ড থেকে ফটিকছড়ির চা বাগানগুলোতে গ্যাস সংযোগ দেয়ার দাবি অনেক পুরনো। ডিজেল ও বিদ্যুৎ চালিত মেশিনের তুলনায় গ্যাসের মেশিনের খরচ অনেক কম। সম্ভবত: ফটিকছড়ির একটি বাগান গ্যাস সংযোগ পেয়েছে।

এটি প্রথমত: সিলেটের সাথে চট্টগ্রামের বৈষম্য, দ্বিতীয়ত: ফটিকছড়ির বাগানে বৈষম্য। তবে পর্যায়ক্রমে ফটিকছড়ির সব বাগানে গ্যাস সংযোগ দেয়া দরকার।

পাঠকের মতামত: