ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

পেয়ারা বাগান করে লাখপতি

pearaসাতকানিয়া প্রতিনিধি :::

দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশে ‘পেয়ারা উৎসব’ চলছে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুরে বসে পেয়ারার জমজমাট পাইকারি বাজার। পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ সুস্বাদু এসব পেয়ারা ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন স্থানে। যায় বিদেশেও। দেশে কয়েক জাতের পেয়ারা রয়েছে। এর মধ্যে চন্দনাইশে উৎপাদিত ‘কাঞ্চননগর পেয়ারা’ স্বাদে অতুলনীয়। শাঁসে বীজের সংখ্যা কম, দেখতে সুন্দর, আকৃতি মাঝারি, খেতে মিষ্টি, সুস্বাদু ও সুগন্ধ এখানকার পেয়ারার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

কাঞ্চননগর পেয়ারার আবাদ ঠিক কখন কার হাত ধরে শুরু হয়েছিল তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারছেন না। তবে আলী আহমদ ও সাঁচি মিয়া নামের দুজন প্রবীণ পেয়ারাচাষি জানান, মূলত বৃটিশ আমলে একজন সরকারি কর্মকর্তা এখানে কিছু পেয়ারার চারা রোপণ করেছিলেন। কয়েক বছর যেতে না যেতে সেই গাছগুলোতে পেয়ারা ধরতে শুরু করে। এসব পেয়ারা সুস্বাদু হওয়ায় পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন বীজ নিয়ে নতুনভাবে চারা রোপণ করেন। কয়েক বছর পর সেখানেও পেয়ারা ধরতে শুরু করলে ধীরে ধীরে কলম ও চারা সংগ্রহ করে ব্যাপকভাবে পেয়ারার আবাদ হয়। বৃটিশ নাগরিকের রোপণ করা গাছের ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে এই অঞ্চলে পেয়ারাচাষ ছড়িয়ে পড়ায় এখানকার পেয়ারাকে শুরুর দিকে ‘বিলাতি বাবুর পেয়ারা’ বলতেন অনেকে। পরে এই জাতের পেয়ারার মূল উৎপাদনস্থল চন্দনাইশের কাঞ্চননগরের নামে নামকরণ হয় ‘কাঞ্চননগর পেয়ারা’।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের পটিয়া ও দোহাজারী রেঞ্জের আওতাধীন পাহাড়ি এলাকায় প্রায় এক হাজার হেক্টর জায়গাজুড়ে পেয়ারাচাষ হয়েছে।
এখানে ছোট বড় মিলে তিন হাজারের অধিক পেয়ারাবাগান রয়েছে।

চাষিরা বছরের শুরুতে বন বিভাগের কাছ থেকে এসব বাগান লিজ নেন। পরে বাগান মালিকদের মধ্যে অধিকাংশ গাছে পেয়ারার ফুল আসার সময় ব্যবসায়ীদের কাছে আগাম বিক্রি করে দেন বাগান। আবার অনেকে নিজেরাই বাগান রক্ষণাবেক্ষণ করে শ্রমিকদের মাধ্যমে পেয়ারা বাজারে বিক্রি করেন। মৌসুমভিত্তিক কিছু খুচরা বিক্রেতাও আছেন। যাঁরা বাজার থেকে পেয়ারা পাইকারি কিনে খুচরা বিক্রি করেন।

সরেজমিন দেখা যায়, চন্দনাইশের কাঞ্চননগর, হাশিমপুর, দোহাজারী এবং পটিয়ার খরনা, কচুয়াই ও কেলিশহরসহ বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকাজুড়ে পেয়ারার বাগান। ছোট বড় পাহাড় ও টিলায় শুধু পেয়ারার বাগান। ভোরে বাগান মালিক ও শ্রমিক বাগানে গিয়ে হলদে সাদা এবং হলদে সবুজ রং ধারণ করা পাকা পেয়ারা ছিঁড়ে এক জায়গায় স্তূপ করছেন। বাগানজুড়ে পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে পাকা পেয়ারা।

আবার কোথাও থোকায় থোকায় ঝুলছে। চাষিরা পেয়ারা ছেঁড়া শেষে ছোট বড় ভাগ করে লাল রঙের কাপড়ের পুঁটলি তৈরি করে বাগান থেকে ভাঁর করে বাজারে নিয়ে যান। পেয়ারা বিক্রির জন্য চন্দনাইশের রৌশন হাট, বাদামতল, সৈয়দাবাদ রেল স্টেশন, বাগিচাহাট ও দোহাজারী রেলস্টেশনে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পাইকারি বাজার বসে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায় এসব পেয়ারা।

কাঞ্চননগর ইউনিয়নের মুরাদাবাদ এলাকার বাসিন্দা ও পেয়ারা বাগানের মালিক মহিব উল্লাহ বলেন, ‘আমার তিনটি বাগান রয়েছে। সব মিলে ১২-১৩ কানি হবে। এগুলো আমার বাবার হাতে করা বাগান। ২ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। বাবার অভাবি সংসারের কারণে লেখাপড়া করতে পারিনি। ছোটবেলা থেকে বাবার সাথে থেকে পেয়ারা বাগান করার অভিজ্ঞতা অর্জন করি। মৌসুম আসলে পেয়ারা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। অন্য সময়ে বাইরে কাজ করতাম। এভাবে চলতে চলতে পেয়ারা বিক্রির টাকায় এক সময় বিদেশে যাই। বিদেশে প্রায় ১০ বছর কাটিয়েছি। সেখানে খুব বেশি সুবিধা করতে পারিনি। দেশে এসে আবার পেয়ারার চাষ করতে শুরু করলাম। পেয়ারা বাগানের লাভের টাকায় ভাইকে বিদেশে পাঠানো এবং বোনদের বিয়েসহ পরিবারের বেশির ভাগ কাজ করেছি। ’

তিনি জানান, পেয়ারা বাগানের তেমন বেশি পরিচর্যা করতে হয় না।

পুরো বছরে দুবার বাগান পরিষ্কার করতে হয়। গাছে কোনো ধরনের সার বা কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় না। এ বছর পাইকারি বাজারে পেয়ারার দাম ভালো রয়েছে। শুরুর দিকে প্রতিভার পেয়ারা ১৫-১৬ শ টাকা বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে প্রতিভার ১২-১৪ শ টাকা। তাঁর বাগান থেকে এ পর্যন্ত ২ লাখ টাকার পেয়ারা বিক্রি করেছেন তিনি। সবকিছু ঠিক থাকলে আরো প্রায় ২ লাখ টাকা বিক্রি হবে।

হাশিমপুর ইউনিয়নের কসাইপাড়ার মো. ইছহাক জানান, আর্থিক দৈন্যতার কারণে তাঁর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি। ছোটবেলা থেকে ওয়ার্কশপে কাজ করেছেন। কাজ শেখার পরও পাঁচ হাজার টাকার অধিক বেতন পাননি। গত ৬-৭ বছর ধরে ওয়ার্কশপের কাজ বাদ দিয়ে পেয়ারা বাগান কিনে বাজারে বিক্রি করছেন তিনি। এ বছর ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ছোট দুটি বাগান নিয়েছেন। বলেন, ‘আমার দুই বাগান থেকে ইতিমধ্যে ৮০ হাজার টাকার পেয়ারা বিক্রি করেছি। আরো ৮০-৯০ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারব। ’

কাঞ্চননগরের মুরাদাবাদের মহিম উদ্দিনের নিজের বাগান নেই। এলাকার বাগান মালিকদের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে ২০ কানির মতো বাগান নিয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যে ২ লাখ টাকার পেয়ারা বিক্রি করেছেন। আরো প্রায় ৩ লাখ টাকার পেয়ারা বিক্রি করতে পারবেন। সব খরচ বাদ দিয়ে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ হবে তাঁর।

তিনি বলেন, ‘আমি সারাবছর সবজি বিক্রি করি। পেয়ারার মৌসুম আসলে তিন মাস পেয়ারা বিক্রি করি। ’

তিনি জানান, খরনা খালের উপর সেতু না থাকায় এবং বাগান এলাকায় রাস্তাঘাট খারাপ হওয়ায় ৮-১০ কিলোমিটার পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে পেয়ারার ভার কাঁধে নিয়ে আসতে সীমাহীন কষ্ট হয়। বাগান এলাকার রাস্তাঘাট গাড়ি চলার উপযোগী হলে পেয়ারা চাষিরা আরো অনেক বেশি লাভবান হতেন।

মুরাদাবাদের আবদুর রহিম বলেন, ‘১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে ১৩ কানি বাগান নিয়েছি। ইতিমধ্যে ২ লাখ টাকার পেয়ারা বিক্রি করেছি। এ বছর পাইকারি বাজারে পেয়ারার মূল্য ভালো। শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক থাকলে যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে দেড় লাখ টাকা লাভ হবে। ’

পাইকারি বিক্রেতা মোহাম্মদ শাহ আলম জানান, দেখতে সুন্দর ও সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে কাঞ্চননগর জাতের পেয়ারার চাহিদা বেশি। বিক্রেতারা এখান থেকে কিনে নিয়ে যান।

তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব, ওমান, দুবাই, কাতারসহ বিভিন্ন দেশে এখানকার পেয়ারার যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। প্রতি মৌসুমে এসব দেশে পেয়ারা রপ্তানি করি আমরা। ’

পেয়ারাচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, এখানে উৎপাদিত পেয়ারা বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট কোনো হাট নেই। নেই পেয়ারা সংরক্ষণের ব্যবস্থা। অনেক বাগান মালিক আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নামমাত্র মূল্যে আগাম বাগান বিক্রি করে দেন।

পেয়ারা বাগানের মালিক নজির আহমদ, মাহামুদর রহমান ও কবির আহমদ জানান, বাগানের মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন, সাধারণ বিক্রি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং চাষিদের আধুনিক প্রযুক্তির আওতায় এনে পেয়ারা চাষ করতে পারলে দ্রুত পাল্টে যাবে এলাকার চিত্র। পেয়ারা চাষ এই অঞ্চলের মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করবে।

চন্দনাইশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. লোকমান হোসেন মজুমদার জানান, পেয়ারা চন্দনাইশের দ্বিতীয় অর্থকরী ফসল। সবজির পর পেয়ারার অবস্থান। কাঞ্চননগর জাতের পেয়ারার মতো সুস্বাদু পেয়ারা দেশের কোথাও উৎপাদন হয় না। সারা দেশে এখানকার পেয়ারার চাহিদা রয়েছে। সঠিক নীতিমালার অভাবে পেয়ারা কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, ‘পেয়ারা চাষিদের সরাসরি সহযোগিতা করার মতো কোনো প্রকল্প আমাদের হাতে নেই। তবে তাঁদের জন্য প্রকল্প প্রণয়ন করা উচিত। এ বিষয়ে আমরা কৃষিমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। পেয়ারা চাষিদের বিষয়ে বিশেষ প্রকল্প হাতে নেবেন বলে তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। ’

কৃষি কর্মকর্তা জানান, এখানকার পেয়ারা দরিদ্র জনগণের পুষ্টির সহজ উৎস হতে পারে। সরকার উদ্যোগী হলে এই অঞ্চলের পেয়ারাকে ঘিরে গড়ে ওঠতে পারে ফুড প্রসেসিং শিল্প। এতে করে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি জুস, জেলি, জ্যাম, চাটনিসহ পেয়ারা জাতীয় নানা সুস্বাদু খাবার দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, চন্দনাইশের পেয়ারাচাষ আরো কীভাবে সস্প্রসারণ করা যায় সেই বিষয়ে কাজ করার জন্য কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পেয়ারা বাগান এলাকার রাস্তাঘাটের যথেষ্ট উন্নয়ন করা হয়েছে। আরো উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে। যাতে পাইকাররা গাড়ি করে বাগানে গিয়ে পেয়ারা কিনে আনতে পারেন। তাতে চাষিরা অধিক লাভবান হবেন।

তিনি বলেন, ‘এখানে পেয়ারাকেন্দ্রিক কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান করতে কেউ এগিয়ে আসলে তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেব। ’

পাঠকের মতামত: