ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

রামু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকট

Ramu Hospital News Pic (4) 3.8.2017খালেদ শহীদ/নীতিশ বড়ুয়া ::

কক্সবাজারের রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে চরম দূর্ভোগে পড়েছে রোগীরা। মাত্র দু’জন চিকিৎসক দিয়ে চলছে জরুরী বিভাগ, বহিঃবিভাগ ও ইওসি’র (ইমার্জেন্সি অবেসটেটিক কেয়ার) ২৪ ঘন্টার কার্যক্রম। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, আবাসিক মেডিকেল অফিসার, চারজন জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন, সার্জারী, গাইনী ও এ্যানেসথেসিয়া), দুইজন মেডিকেল অফিসার ও একজন ডেন্টাল সার্জনসহ নয়টি পদের মধ্যে দু’জন মেডিকেল অফিসারই ৩১ শয্যা রামু উপজেলা হাসপাতালের যাবতীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসক ও জনবল সংকটের কারনে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীদের ভোগান্তি চরম আকার ধারন করেছে। গাইনি চিকিৎসকের অভাবে প্রসূতিরা সঠিক চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না। ফার্মাসিষ্ট ও স্বাস্থ্য সহকারি বর্তমানে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।

গত বৃহস্পতিবার সকালে রামু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা খুনিয়াপালং ইউনিয়নের দারিয়ারদীঘি এলাকার হার্টে অসুস্থ রোগী আবদুর রহিম জানান, সকাল থেকে অপেক্ষা করেছি ডাক্তার দেখাবো বলে। প্রায় চার ঘন্টা অপেক্ষার পর ডাক্তার দেখালাম। এ হাসপাতালে আমার মতো রোগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয় জানিয়ে, ডাক্তার আমাকে কক্সবাজার রেফার করলেন। ঈদগড় থেকে আসা প্রসূতি রোগী জরিনা বেগমের স্বজনরা জানান, হাসপাতালে গাইনী চিকিৎসক নেই। তাই এ হাসপাতালে জরিনা বেগমের চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছেনা। কারণ জরিনা বেগমের স্বাভাবিক প্রসব নাও হতে পারে।

দু’জন চিকিৎসক দিয়ে তো হাসপাতাল চলতে পারেনা। এ ব্যাপারে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে আমি লিখিত ভাবে জানিয়েছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা পরিচালক মহোদয়ও কক্সবাজার এসেছেন, আশাকরি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এ সমস্যার সমধান হবে বলে জানান, কক্সবাজার সির্ভিল সার্জন ডা. মো: আবদুস সালাম।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার সদর হাসপাতাল দূরে হওয়ায় রামু উপজেলার এগার ইউনিয়ন ছাড়াও কক্সবাজার সদর উপজেলার খরুলিয়া, ভারুয়াখালী, ঈদগাও, চৌফলন্ডি এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার লোকজনও এখানে চিকিৎসা নিতে আসায় প্রচন্ড চাপে রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। উপজেলার সাড়ে ৩ লক্ষ লোকসহ ওই সব এলাকার রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে রীতিমত হিমশীম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। জরুরী বিভাগ প্রায় সময় শূন্য থাকায় চিকিৎসা সেবা নিতে আসা লোকজনদের সাথেও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। অনেক সময় সার্জারী বিভাগে চিকিৎসক না থাকায় সংকটাপন্ন রোগীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কক্সবাজার সদর হাসপাতাল কিংবা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

হাসপাতাল সূত্র আরো জানায়, হাসপাতালে ৯ জন চিকিৎসক, তৃতীয় শ্রেণীর ৯১ জন, চতুর্থ শ্রেণীর ২০ জন কর্মচারী পদ থাকলেও বর্তমানে দুই জন মেডিকেল অফিসার দিয়ে চিকিৎসা সেবা চলছে রামু স্বাস্থ্য কমপেক্সে। দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে চিকিৎসা সহকারী, ফার্মাসিষ্ট, মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট (রেডিও), ক্যাশিয়ার ও ১১জন স্বাস্থ্য সহকারীসহ তৃতীয় শ্রেণীর ১৭ টি ও চতুর্থ শ্রেণীর ৬ টি পদ।

চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালটি ৩১ শয্যা হলেও প্রতিদিন অন্তর্বিভাগে ৩৫ থেকে ৫০ জন রোগী ভর্তি করতে হয়। বাধ্য হয়ে তখন রোগীদের হাসপাতালের বারান্দায় রাখতে হয়। বর্হিবিভাগেও প্রতিদিন সাড়ে তিনশ থেকে চারশ রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিতে হয়। এছাড়া রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে হওয়ায় এ হাসপাতালে ইওসি (ইমার্জেন্সি অবসটেটিক কেয়ার) কার্যক্রমও চালু আছে। সরকার মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে ২০০৫ সাল থেকে এ হাসপাতালে মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কীম (জরুরী প্রসূতি সেবা) চালু করে। এ প্রকল্পের আওতায় ২০০৭ সালের ১৪ জুলাই গাইনী বিভাগের অস্ত্রপচার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু গাইনী কনসালটেন্ট না থাকায় গত ১৭ মাস ধরে অস্ত্রপচার বন্ধ রয়েছে। টেকনেশিয়ানের অভাবে প্রায় পনের লক্ষ টাকা দামের এক্সরে যন্ত্রটি অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। হয়ত একদিন এক্সরে মেশিনটি অচল যন্ত্রাংশে প্ররিণত হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. শামীম রাসেল জানান, কাউয়ারখোপ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকলেও চিকিৎসক সংকটের কারণে বর্তমানে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও এবং জরুরী বিভাগের সকল দায়িত্বও পালন করতে হচ্ছে। বহির্বিভাগে তিনি অথবা ডা. রাজেদ আল হাসান প্রতিদিন সাড়ে তিন থেকে চারশ রোগীকে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাছাড়া জরুরী বিভাগ ২৪ ঘন্টা খোলা থাকায় এখানেও দিনে-রাতে ত্রিশ থেকে চল্লিশ জন রোগী দেখতে হয়। যন্ত্রের মত দায়িত্ব পালন করলেও সেবার মান ঠিক রাখা যাচ্ছে না। একটু এদিক ওদিক হলেই অপ্রীতিকর ঘটনার সম্ভবনা রয়েছে। মহাসড়কের পাশে হওয়ায় প্রায় সময় সড়ক দূর্ঘটনার ঘটনা ঘটে। অনেকটা চাপের মধ্যে থাকতে হয়, সব কিছু সঠিক ভাবে হয়না। আমরা দু’জন চিকিৎসক দায়িত্ব ভাগ করে ২৪ ঘন্টা চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি।

হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ডলি বিশ্বাস জানান, হাসপাতালে গাইনী ডাক্তার নেই, প্রসূতিদের চিকিৎসা সেবা দিতে হয় নার্সদের। প্রতিমাসে এ হাসপাতালে প্রায় ৭০ জন প্রসূতি রোগীকে সেবা দেয়া হচ্ছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারী মাস থেকে সিজারিয়ান প্রসূতির রোগীর চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও প্রতিদিন ৪-৫ জন ম্যালেরিয়া রোগীর সেবা দিচ্ছেন নার্সরা। তারপরও রামু হাসপাতালের নার্সরা সর্বোত্তম ভাবে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন বলে তিনি দাবি করেন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় কক্সবাজার জেলায় মডেল উপজেলা হিসেবে একমাত্র রামু হাসপাতালে ২০০৫ সালে ভিমান্ড সাইড ফাইনান্সিং (ডিএসএফ) কার্যক্রম শুরু করে। সেবার মান ও রোগীরা কিছু সুযোগ সুবিধা পাওয়ায় অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা পায় ডিএসএফ কার্যক্রম। কিন্তু বর্তমানে রামু হাসপাতালে গাইনী বিশেষজ্ঞ না থাকার কারণে প্রসূতি মায়ের অস্ত্রপচার বন্ধ থাকায় হুমকির মুখে পড়েছে প্রসূতি ও গর্ভবতী মায়েদের সেবা। বর্তমানে সেবিকারা এ প্রকল্পের কার্যক্রম চালাচ্ছেন। ফলে একটু সমস্যা দেখা দিলেই রোগীকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রেফার করতে হচ্ছে। এতে রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, মেডিকেল অফিসার ডা. রাজেদ আল হাসান। তিনি বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবদুল মান্নান সম্প্রতি বদলি আদেশ প্রাপ্ত হয়ে, টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করেছেন। তিনি বদলি আদেশ পাওয়ার আগে কয়েকবার রামু হাসপাতালে চিকিৎসক দেওয়ার জন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার আবেদন জানিয়েছেন। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে অবগত আছেন।

তিনি বলেন, তিনি ছাড়া অপর একজন চিকৎসককেই হাসপাতালের যাবতীয় কার্যক্রম দেখতে হচ্ছে। দায়িত্ব নিয়ে একজন চিকিৎসক দু’জনের কাজ করতে পারেন, কিন্তু কোন একজন চিকিৎসক একা চারজনের কাজ করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সহকারীদের সহযোগিতা নিয়েই আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসক ও জনবল ঘাটতির কারনে ভোগান্তি হচ্ছে প্রচুর। হাসপাতালে এখন মেডিকেল অফিসারের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী জরুরী। তিনি আরো বলেন, এগার ইউনিয়নের রামু উপজেলায় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের কোনটিতেই চিকিৎসক নেই।

এ ব্যাপারে রামু হাসপাতাল স্বাস্থ্য সেবা কমিটির সভাপতি কক্সবাজার-৩ আসানের সাংসদ আলহাজ্ব সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, রামুতে চিকিৎসক সংকট নিয়ে বিরাজমান সমস্যার কথা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানানো হয়েছে। আশাকরছি অতিদ্রুত এ সমস্যার সমধান হবে।

পাঠকের মতামত: