ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

মিতুকেও হারালাম, চাকরিও হারালাম : বাবুল

babul-1পরিবর্তন:

ছলছল চোখ আর কান্নাজড়িত কণ্ঠে এক সময়ের দুর্দান্ত প্রতাপশালী পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার, লিকলিকে শরীরে তার বেডরুমে দাঁড়িয়ে আছেন। কান্না চেপে রাখা কণ্ঠে শুধু বলে গেলেন, ‘(আই লস্ট মাই ওয়াইফ, আই লস্ট মাই জব) আমি আমার স্ত্রীকে হারিয়েছি, চাকরিও হারিয়েছি।’ একটু থেমে বললেন, ‘সন্তানদের নিয়ে এখন আতঙ্কে আছি।’

পরিবর্তন ডটকমের সঙ্গে রোববার একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আখতার।

বাবুল আখতারের শ্বশুর মোশারফ হোসেন বেশ কিছুদিন ধরেই নানাভাবে অভিযোগ করে যাচ্ছেন মাহমুদা খানম মিতু হত্যার পেছনে বাবুল দায়ী। সে প্রসঙ্গ টেনে বাবুল আখতারের কাছে পরিবর্তন ডটকমের প্রশ্ন ছিল আপনাকে মিতু হত্যার জন্য দায়ী করা হয়, আপনি কি বলবেন যে আপনি দায়ী নন? সাবেক এ পুলিশ কর্মকর্তা অনেকটা পুলিশি কায়দায় পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, ‘আমি কেন বলব যে আমি দায়ি? কোনো অপরাধীই বলে না যে সে দায়ী। সবতো তদন্তেই বেরিয়ে আসবে। তখন জানবেন।’

বাবুল আখতার অনেকটা অকপটে বলে যান, ‘সবাইতো সব জানেন। আমি কীভাবে ডিবিতে গিয়েছি, কখন অন্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছি।’

দুই দুইবার রাষ্ট্রপতি পদকে ভূষিত সাবেক এ পুলিশ কর্মকর্তা তার নতুন কর্মস্থলে চাকরির চ্যালেঞ্জের কথাও বলেন। নিজে মন দিয়ে চাকরি করছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুগত থেকে। মাঝে পত্রপত্রিকায় নানা রং চং লেখালেখির কারণে  নতুন চাকরিটাতে ঝক্কি কম হয়নি। এখন সেসব কাটিয়ে উঠেছেন অনেকটাই। বাবুল আখতার বলেন, ‘এক সময় মনে হতো হাতে চার পাঁচ লাখ টাকা থাকলে চাকরি করতাম না।’

বাবুল আখতারের ড্রইংরুম ভর্তি পুলিশে চাকরির সময়ের ছবি। কী নেই সেখানে। অনেক কৃতিত্ব আর সম্মান স্মারক এক পাশের দেওয়াল ঠাসা। কিন্তু এক সময় আক্ষেপ করে বললেন, ‘কী আছে এসবে, এগুলো কিছু না।’ কেন এ অভিমান— জানতে চাইলে বাবুল চুপ হয়ে থাকেন কিছু সময়।

বাবুল আখতার আবারও সন্তান প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বললেন, ‘আমার বাচ্চারা সব সময় একটা পরিছন্ন ছিমছাম ঘরে থাকতে পছন্দ করে। আমি তাদের সেটাই দিতে চেষ্টা করছি।’

চটপটে দুই সন্তান নিয়ে ঘরের ভেতর ব্যস্ত সময় কাটিয়ে বাবুল পরিবর্তন প্রতিবেদককে রোববার রাত আটটার দিকে বিদায় দিয়ে বলেন, ‘সন্তানদের নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেবেন, তারপর তারাবির নামাজ পড়ে ঘুমাবেন।’

এটুকু বিদায় পর্ব শেষ হতে না হতেই পেছন থেকে মাত্র তিন বছরের শিশু তাবাসসুম তাজমিন টাপুর তার বাবা বাবুল আখতারকে ডেকে অনেকটা চিৎকার করে জানতে চাইল, বাবা কালকে জুনের ৫ তারিখ? টাপুরের এ প্রশ্নের পেছনে তার মা মাহমুদা খানম মৃত্যুর দিনের কথাই মনে পড়ছিল কিনা সে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশই ছিল না ছোট মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে।

বাবুল আখতার আবারো বললেন, ‘পেছনের দিনগুলো যে পরিমাণ কষ্টে কাটিয়েছেন তা কেবল যে কাটায় সেই জানে, কি গেছে তার জীবনে।’

গত বছরের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম মহানগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে খুন হন বাবুলের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। সে সময় পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদর দফতরে যোগ দিতে ঢাকায় ছিলেন বাবুল।

চট্টগ্রামে জঙ্গি দমনে আলোচিত বাবুল আক্তার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনারের দায়িত্ব থেকে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদর দফতরে যোগ দেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় খুন হন তার স্ত্রী।

মিতু হত্যায় প্রথম দিকে জঙ্গিদের হাত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল। কিন্তু গত ২৪ জুন মধ্যরাতে হঠাৎ বাবুল আক্তারকে মিতু হত্যায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাজধানীর বনশ্রীর শ্বশুরের বাসা থেকে তুলে নিয়ে আসা হয় মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে। ১৬ ঘণ্টা পর তাকে ২৫ জুন সন্ধ্যায় আবার শ্বশুরের বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়।

এরপরই চারদিকে গুঞ্জন শুরু হয় স্ত্রী হত্যার অভিযোগের তীর বাবুলের দিকে। এবং চাকরি থেকে অব্যাহতি দিচ্ছেন তিনি। এরমধ্যে চট্টগ্রামে গিয়ে একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের পর চাকরি করার মতো মানসিক অবস্থা না থাকায় বাবুল আক্তার চাকরি থেকে অব্যাহতি পেতে পদত্যাগপত্র দিয়েছেন।’ কিন্তু এর কয়েকদিন পর গত ৪ আগস্ট পুলিশ সদর দফতরে গিয়ে কর্মস্থলে পদায়ন চেয়ে একটি লিখিত ব্যাখ্যা দেন বাবুল।

গত ৯ আগস্ট চাকরি থেকে অব্যাহতির আবেদনপত্র প্রত্যাহার চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর আরেকটি আবেদন করেন বাবুল আক্তার। ওই আবেদনপত্রের একটি অংশে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বিগত ২৪-০৬-২০১৬ ইং তারিখে পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে বাধ্য হয়ে আমাকে চাকরির অব্যাহতিপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়। একজন সৎ পুলিশ অফিসার হিসেবে এবং আমার সন্তানদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন এ চাকরি। এমতাবস্থায় ওই অব্যাহতিপত্রটি প্রত্যাহারের আবেদন জানাচ্ছি।’ কিন্তু তার সেই আবেদনপত্র আর গ্রহণযোগ্য হয়নি। অবশেষে আইনি প্রক্রিয়া শেষে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার প্রথম আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করছেন।

পাঠকের মতামত: