ঢাকা,রোববার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

দালালরা বেকার! বদলে গেছে রামু ভূমি অফিস

ভূমি অফিস চত্বরে গণশুনানির আয়োজন করেন রামু উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রকৌশলী মো. নিকারুজ্জামান।

ramu অনলাইন ডেস্ক :::

কক্সবাজারের রামু উপজেলার রাজারকুল গ্রামের মৃত নজু মিয়ার ছেলে আবদুস সালাম (৪৮)। পড়ালেখার খরচ জোগানোর সামর্থ্য ছিল না তাঁর বাবা-মার। এ কারণে ছোটবেলায় অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে স্থানীয় ছুরতিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করতেন। সেখানে তিনি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। আর্থিক টানাপড়েনে সংসারের হাল ধরতে বাধ্য হওয়ায় পড়ালেখার ইতি টানতে হয় তাঁকে। ঠেলাগাড়ি চালিয়ে সংসার চালান সালাম।

রাজারকুলের যে ঘরে তিনি লজিং ছিলেন সেই পরিবারের দানশীল গৃহকর্তা তাঁকে দান করেছিলেন তিন শতক ভিটিজমি। ওই ভিটি জমিতে ঠেলাগাড়িচালক সালামের কুঁড়েঘর। দান করা জমিখণ্ডটির নামজারি করে দেওয়ার জন্য তিনি এক দালালের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। দালাল জমি নামজারিতে নানা খরচের অজুহাতে আট হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। বিনিময়ে তাঁর ভিটিজমির পরিবর্তে খতিয়ান করে দিয়েছে নালজমি। মহা বেকায়দায় পড়েন সালাম। দানের ভিটিজমিতে তিনি বাস করছেন। অথচ ভূমি অফিসের দালাল তাঁকে নামজারি করে দিয়েছে ভিন্ন স্থানের নালজমি। এরকম নামজারি ভবিষ্যতে তাঁর সন্তানদের জন্য দুর্ভোগের কারণ হতে পারে! সালাম সেই ভূমি অফিসের মোহরার নামে পরিচিত দালালের কাছে গিয়ে প্রতিকার চাইলে দালাল নতুন করে আবেদনের জন্য আবার বড় অংকের টাকা দাবি করে বসে।

এভাবেই ভূমি অফিসের দালালরা একটি বিষয়কে সহজেই সমাধান করার চেয়ে উল্টো কাজ করে দেয়। এটা এমন এক কৌশল-যাতে বছরের পর বছর ধরে একটি মামলা থেকেই বার বার টাকা হাতিয়ে নেওয়া যায়। ঠেলাগাড়িচালক আবদুস সালাম শেষপর্যন্ত রামু উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর (এসি ল্যান্ড) শরণাপন্ন হলেন। তিনি সব ঘটনা খুলে বললেন এসি ল্যান্ডকে। তিনি তাঁকে একটি মিচ মামলা করার পরামর্শ দিলেন। দরিদ্র ঠেলাগাড়ি চালকের আগের খতিয়ান শুদ্ধ করে দিলেন রামু উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নিকারুজ্জামান।

এ প্রসঙ্গে ঠেলাগাড়িচালক সালাম বলেন, ‘রামুর এসি ল্যান্ড অফিসে এসে দ্রুত সময়ে বিনা খরচে আমার কাজটি করতে পারায় মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে শোকরিয়া আদায় করছি। এ জন্য আমি দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে দেব। ’

তিনি আরো বলেন, ‘এখানে  আগে কী ভোগান্তি ছিল সেটা আমাদের মতো ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারো জানার কথা নয়। যেমন টাকা খরচ তেমনি ছিল শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম। আর এখন ছিমছাম অফিসটিতে যাওয়া মাত্র কাজের সমাধান পাওয়া যায় সহজেই। ’

রামু উপজেলার উত্তর মিঠাছড়ি চাবাগান এলাকার বাসিন্দা মৃত ফকির মোহাম্মদের ছেলে নুরুল হাকিম (৫৫) বলেন, ‘বিএস সংশোধনী মামলা করেই বাদী-বিবাদী অতি দ্রুততার সাথে আমাদের জমি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করতে পেরেছি। ’

রামু উপজেলা সদরের অফিসের চর এলাকার বাসিন্দা আনসারুল করিম জানান, সম্প্রতি ভূমি সপ্তাহ উদযাপনকালে তিনি রামু এসি ল্যান্ড অফিস থেকে নিয়েছেন মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে একটি খতিয়ানের সহিমুহুরি নকল কপি। যা আগে নিতে খরচ হত দুই থেকে তিন শ টাকা। এমনকি নতুন একটি নামজারি খতিয়ান সৃজন করেছেন মাত্র এক হাজার ১৫০ টাকার বিনিময়ে। অথচ একটি নতুন খতিয়ানে খরচ পড়ত ৫/৬ হাজার টাকা।

রামু এসি ল্যান্ড অফিস নিয়ে অভিযোগেরও শেষ ছিল না। এখানকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল দুর্নীতি। দালালের উপদ্রব ছিল সবচেয়ে বেশি। দালালরাই কর্মকর্তা আর বেঞ্চ সহকারীদের নাম দিয়ে ‘ঘুষের টাকা’ হাতিয়ে নেয়। এমন অবস্থায় ২০১৬ সালের ১ আগস্ট উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে যোগ দেন বিসিএস ক্যাডারের চৌকস কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. নিকারুজ্জামান। এর পর থেকে বদলে যায় চিত্র। দালালরা হয়ে যায় বেকার!

নিকারুজ্জামান যোগ দিয়েই অফিসটিতে দীর্ঘদিন ধরে চলমান অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে জনদুর্ভোগ নিরসনের কাজে হাত দেন। প্রথমেই অফিসে আসা সেবাপ্রত্যাশী লোকজনের বসার জন্য একটি ‘গোলঘর’ নির্মাণ করার কথা মাথায় আনেন। তিনি এ জন্য উপজেলা পরিষদ থেকে এক লাখ টাকার বরাদ্দ নেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল দেন ৫০ হাজার টাকা।

রামু উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রকৌশলী মো. নিকারুজ্জামান জানান, এক লাখ ৫০ হাজার টাকায় গোলঘর নির্মাণসহ একটি জেনারেটর ও অফিসে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। সেই সাথে পুরনো নথি রাখার জন্য তৈরি করা হয় তাক। বছরের পর বছর ধরে অফিসে অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকা মূল্যবান কাগজের নষ্ট হওয়া নথিগুলোকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন তিনি। এসব প্রতিটি নথিতে সাল ও মামলা নম্বর লিখে ‘পতাকা’ লাগিয়ে সাজানো হয়। এতে প্রয়োজনীয় নথি বা ফাইলটি এখন মুহূর্তেই বাছাই করে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। অফিস চলাকালীন সময়ে অফিসের কর্মচারীদের গলায় নিজের পরিচয়পত্র ঝুলানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কর্মচারীদের গলায় পরিচয়পত্র দিয়েই সেবা প্রত্যাশীদের দালাল থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সরেজমিন দেখা যায়, গোলঘরটিতেই সেবাপ্রত্যাশীদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে এসি ল্যান্ড নিজেই বসে সেবাপ্রত্যাশীদের গণশুনানি করেন। মিচ মামলাগুলো গোলঘরে বসে তিনি সমাধান দিচ্ছেন অত্যন্ত সীমিত সময়ের মধ্যে। সেবাপ্রত্যাশীদের জন্য সরকারি নির্ধারিত ফি এবং কোন খাতে কত রাজস্ব দিতে হয় তার বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করে চার্ট টাঙানো হয়েছে। সেবার জন্য আসা সবাইকে জানানো হয়, এখানে সরকারি ফি ছাড়া অন্য কোনো খাতে টাকা নেওয়া হয় না। বিনা মূল্যে সকল প্রকারের ফরম সরবরাহ করা হয়।

জানা গেছে, প্রকৌশলী মো. নিকারুজ্জামান ‘রম্যভূমি রামু’ নামের একটি মোবাইল অ্যাপস তৈরি করেছেন। যে কোনো ব্যক্তি ঘরে বসেই সেই অ্যাপস থেকে রামুর যেকোনো এলাকার একখণ্ড জমিও খুঁজে বের করতে পারবেন। এ জন্য কক্সবাজার ডিজিটাল মেলায় শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবকের পুরস্কারও পান তিনি। এছাড়া রামু উন্নয়ন মেলায় উপজেলা ভূমি অফিসের স্টল প্রথম হয়।

রামুর প্রতিবন্ধী রিকশাচালক আবদুল গফুর (৫৫) বলেন, ‘দেশের সব ভূমি অফিস যদি রামুর মতো ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত হত তাহলে সত্যিই এদেশ প্রকৃত সোনার বাংলা হত। ’

গফুর জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের চা-বাগান এলাকার বাসিন্দা। বসতভিটা ছাড়া কোনো সহায় সম্বল নেই তাঁর। সেই ভিটারও খতিয়ান নেই। আর টাকাও নেই যে, একমাত্র সম্বল ভিটার জমিখণ্ডটির খতিয়ান সৃজন করার জন্য। ছুটে যান ভূমি অফিসে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রকৌশলী মো. নিকারুজ্জামান কোনো টাকা ছাড়াই এই গফুরের ভিটার খতিয়ান সৃজন করে দেন। তিনি নিজের ভিটার খতিয়ান হাতে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা।

পাঠকের মতামত: