ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

পর্যটন সম্ভাবনার সোনাদিয়া দ্বীপে এখনও দেখা মেলে বিলুপ্তপ্রায় চামচ-ঠুঁটো-বাটান পাখি

0111আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার :::

ভার্জিন বীচের জন্য বিখ্যাত সোনাদিয়া দ্বীপটিকে ঘিরে গড়ে ওঠতে পারে দেশের এক সম্ভাবনায় পর্যটন কেন্দ্র। কক্সবাজার শহরের নিকটবর্তী ছোট্ট এ দ্বীপটি ইতোমধ্যে নজর কেড়েছে পর্যটকদের। এই দ্বীপে পর্যটকদের জন্য কোন সুবিধা গড়ে না ওঠলেও আগ্রহী হাজার হাজার পর্যটক ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ প্রতিবছর সোনাদিয়া দ্বীপে ভ্রমণে যাচ্ছেন। জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ ও অত্যন্ত আকর্ষণীয় এ দ্বীপে শীতকালে হাজার হাজার অতিথি পাখি বা পরিযায়ী পাখি আসে। সুদূর সাইবেরিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে উষ্ণতার খোঁজে বেরিয়ে পড়া এই পাখিরা হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আসে কক্সবাজারের সোনাদিয়ায়। এরমধ্যে বিশ্বব্যাপী বিলুপ্তপ্রায় চামচঠুঁটোবাটান পাখি বা কাদাখোঁচা দেখা যায় সোনাদিয়ায়। দেশের আর কোথাও এই পাখির দেখা মেলে না। সারা বিশ্বে এ প্রজাতির মোট পাখির ১০ শতাংশ রয়েছে সোনাদিয়ায়। বিশ্বজুড়ে বিপন্ন ‘নর্ডম্যান সবুজ পা’ পাখির দেখা মেলে এখানে। এ দ্বীপটি বাংলাদেশের পাখির ২০তম গুরুত্বপূর্ণ অভয়ারণ্য। লাল কাঁকড়া, বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিমও এ দ্বীপে বেশি পরিমাণে দেখা যায়। সাগরঘেরা এ দ্বীপে রয়েছে ১ হাজার ২১৫ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল। এর মধ্যে ৫৬৭ প্রকারের উদ্ভিদ, ১৬২ প্রকারের শামুক, ২১ প্রকারের কাঁকড়া, ১৯ প্রকারের চিংড়ি, ২ প্রকারের লবস্টার, ২০৭ প্রকারের মাছ, ১২ প্রকারের উভচর প্রাণী, ১৯ প্রকারের সরীসৃপ ও ২০৬ প্রকারের পাখি।

আইইউসিএন ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব গত (২০১৫ সাল) বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত দেশের পাঁচটি স্থানে পাখি শুমারি করে। শুমারিতে ওই পাঁচ স্থানে ১ লাখ ১২ হাজার পরিযায়ী পাখি পাওয়া গেছে। শুমারিটি করা হয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওর, দোমার চর, হাকালুকি হাওর, বাইক্কা বিল ও সোনাদিয়া দ্বীপে। এরমধ্যে সোনাদিয়া দ্বীপে ৯২০টি ছোট ধুলজিরিয়া ও ২৫০টি বড় ধুলজিরিয়া পাখির দেখা মিলেছে। এ ছাড়া এখানে বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন নয়টি চামচ ঠুঁটো বাটানেরও দেখা মিলেছে। দেখা পাওয়া গেছে বিশ্বজুড়ে বিপন্ন ছয়টি নর্ডম্যান সবুজ পা।

এখানে রয়েছে দৃষ্টি নন্দন প্যারাবনও। এখানকার প্যারাবন পৃথিবী বিখ্যাত বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। প্রজাপতির প্রজননের অভয়ারণ্য সোনাদিয়া। অসংখ্য লাল কাঁকড়ার মিলন মেলাস্থল এই দ্বীপ। রয়েছে দূষণ ও কোলাহলমুক্ত সৈকত। দ্বীপের অভ্যন্তরে রয়েছে প্যারাবন ঘেরা ছোট ছোট নদী। এসব নদীতে ভ্রমণ করতে পর্যটকরা বেশ আনন্দ পায়। এ কারণে দ্বীপটি ঘিরে পর্যটকদের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে বলে জানান কক্সবাজার ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এসএম কিবরিয়া খান।

তিনি বলেন, ভার্জিন বীচের জন্য বিখ্যাত সোনাদিয়া দ্বীপটিকে ঘিরে দেশের এক সম্ভাবনায় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠতে পারে। এখনও এই দ্বীপে পর্যটকদের জন্য কোন সুবিধা গড়ে না ওঠলেও আগ্রহী হাজার হাজার পর্যটক ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ প্রতিবছর সোনাদিয়া দ্বীপে ভ্রমণে যাচ্ছেন। বিশেষ করে কক্সবাজার শহরের একেবারেই নিকটবর্তী একটি দ্বীপ হওয়ায় সোনাদিয়ার প্রতি পর্যটকদের আগ্রহ দিনদিন বেড়েই চলেছে।

কক্সবাজার শহরের উত্তর পশ্চিম পাশে, নাজিরার টেক সংলগ্ন সাগর চ্যানেলের ওপারে অবস্থিত সোনাদিয়া দ্বীপটি কক্সবাজার শহর থেকে সাগর পথে মাত্র ৫/৬ কিলোমিটার দুরত্বে হলেও প্রশাসনিকভাবে মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড মাত্র।

সোনাদিয়ায় মোট জমির পরিমাণ ২৯৬৫.৩৫ একর। এরমধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির পরিমাণ মাত্র ৩.১৫ একর। এখানে শুটকী মহাল রয়েছে ২টি। এখানকার শুটকী বিখ্যাত। এখানে বন বিভাগের জমি রয়েছে ২১০০ একর। বাকী সব প্রাকৃতিক বনায়ন ও বালুকাময় চরাঞ্চল। সোনাদিয়া সাগরে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, সূর্যাস্তের দৃশ্য, প্যারাবন বেষ্টিত আকাঁবাঁকা নদী পথে নৌকা ভ্রমণ অত্যন্ত উপভোগ্য। স্পীড বোট দিয়ে মহেশখালী চ্যানেল হয়ে সোনাদিয়া যাওয়ার পথে বঙ্গোপসাগরের দৃশ্য অবলোকন পর্যটকদের জন্য বাড়তি আর্কষণ। এখানে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর গড়ে তোলার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

সোনাদিয়া দ্বীপের নামের সাথে মিশে আছে এ অঞ্চলের ইতিহাস ও কিংবদন্তী। কথিত আছে, একটি ডুবন্ত জাহাজে পলি ও রাশি রাশি বালি জমে সোনাদিয়া দ্বীপের সৃষ্টি হয়। প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণসহ অন্যান্য মালামাল বোঝাই একটি বিদেশী বাণিজ্যিক জাহাজ মহেশখালী উপকূলের কাছাকাছি দিয়ে যাওয়ার সময় বর্তমান সোনাদিয়া এলাকায় পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবলে পড়ে। এসময় জাহাজের নাবিকদের সাথে জলদস্যুদের সংঘর্ষের ফলে জাহাজটি ডুবে যায়। পরে দূর্ঘটনাস্থলে পলি ও বালি জমে দ্বীপের সৃষ্টি হলে জেলেরা দ্বীপটির নাম দেয় স্বর্ণ দ্বীপ বা সোনাদিয়া। কারো মতে, প্রায় পৌনে ৩শ বছর আগে লুতু বহদ্দার নামের এক জেলে জেগে ওঠা চরে জাল বসিয়ে একটি আকর্ষণীয় পাথর পায়। পাথরটি ঘরে নিয়ে এসে দরজার সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার শুরু করে। একদিন এক নাপিত কাঁচি শান দিতে গিয়ে দৈবক্রমে পাথরটি ভেঙ্গে গেলে এর ভেতর থেকে একটি স্বর্ণমূদ্রা বেরিয়ে আসে। যা বিক্রি করে লুতু বহদ্দার ও নাপিত বেশ লাভ করে। সেই থেকে দ্বীপের নাম হয় সোনাদিয়া। তবে দ্বীপ সৃষ্টি সম্পর্কে ভূতত্ত্ববিদ ও ভূগোলবিদরা বলেন, মহেশখালী প্রণালী ও বাঁকখালী নদীর স্রোতধারার সাথে সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে এই দুই এলাকার মাঝামাঝিস্থানে কোটি কোটি টন বালি জমে সোনাদিয়া দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে।

তবে এ দ্বীপটি যেহেতু বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী এ দ্বীপে পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন সব কর্মকান্ড নিষিদ্ধ রয়েছে, সেজন্য প্রচলিত ট্যুরিজমের পরিবর্তে এখানে ইকো ট্যুরিজমের বিকাশ ঘটাতে হবে বলে মনে করেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।

এবিষয়ে দেশের বিশিষ্ট পাখি বিজ্ঞানী ও বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ..ম আমিনুর রহমান বলেন, সোনাদিয়া দ্বীপ নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। তবে দ্বীপটি যেহেতু একটি জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা সেহেতু এখানে সব উন্নয়ন করতে হবে পরিবেশের কথা মাথায় রেখে। এ েতে্র ইকোট্যুরিজমের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা মতে, প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে মিলিয়ে সোনাদিয়া দ্বীপে সরকারিবেসরকারি উদ্যোগে ইকোরিসোর্ট গড়ে তোলা হবে। তবে এমন একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে একটু সময় লাগবেই। কারণ কাজ বাস্তবায়নের আগে সরকারকে অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে মিলিয়ে সোনাদিয়া দ্বীপকে ঘিরে পরিবেশবান্ধব পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে পর্যটন মন্ত্রণালয়। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারি সোনাদিয়া দ্বীপ পরিদর্শন করেন পর্যটন সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী। পরিদর্শন শেষে কক্সবাজার বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির বৈঠকে সোনাদিয়া দ্বীপের কোনো জমি কাউকে লিজ না দিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে নতুনভাবে বসতি গড়ার বিষয়টিও নিরুৎসাহিত করতে নির্দেশনা দেয়া হয়। পাশাপাশি দ্বীপে বসবাসকারীদের অন্যত্র পুনর্বাসনের বিষয়েও একটি রূপরেখা তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়। তবে এরপর বিষয়টি নিয়ে সরকারের কোন দপ্তরের কোন তৎপরতা পরিল িত হয়নি।

পাঠকের মতামত: