ঢাকা,সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

টেকসই নির্মাণে বাধা কোথায়?

চকরিয়ায় বন্যা হলেই ভেঙে লন্ডভন্ড হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::  কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় যখনই বন্যা দেখা দিয়েছে, তখনই লণ্ডভণ্ড হয়েছে বিভিন্ন দপ্তরের সড়ক ও গ্রামীণ অবকাঠামো। বন্যা পরবর্তী যোগাযোগের এসব মাধ্যম ফের সচল করা হলেও তা কোনোভাবেই টিকছে না। কারণ এসব সড়ক বা গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে টেকসইভাবে প্রকল্প গ্রহণ করা হয় না। এতে যখনই বন্যা হয়, বারবার ভেঙে যাচ্ছে সড়কগুলো।

বিশেষ করে মাতামুহুরী নদী বিধৌত ইউনিয়নগুলোর অবস্থা বেশ করুণ। আবার উপকূলীয় এলাকার সড়কগুলোও সামুদ্রিক অস্বাভাবিক জোয়ারের পানির চাপে ভাঙছে হরহামেশাই। এসব সড়ক পুনরায় চলাচল উপযোগী করতে গিয়ে সরকারি টাকার দেদার জলাঞ্জলিও হচ্ছে। এতে টেকসই ও নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি না হওয়ায় জনদুর্ভোগ প্রতি বছরই বাড়ছে। বন্যা বা জ্বলোচ্ছ্বাসে ভুক্তভোগী এলাকার মানুষরা বলছেন, সরকারি কোনো দপ্তরই এসব সড়ক বা গ্রামীণ অবকাঠামোতে টেকসই তথা আরসিসি, ইউনি ব্লক এবং সাবমারসিবল প্রযুক্তির ব্যবহার করে না।

যদিওবা দেশের বিভিন্ন স্থানে এই প্রযুক্তিতে সড়ক বা গ্রামীণ অবকাঠামো টেকসইভাবে নির্মাণ করায় সুফল মিলেছে। আবার সরকারের নীতি নির্ধারণী ফোরাম থেকেও বন্যা উপদ্রুত এলাকায় এই প্রযুক্তির প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশনা থাকলেও মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর বিষয়ে অনীহা দেখা গেছে। এর পেছনের কারণ কী, এমন প্রশ্নে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং এলজিইডির মাঠ পর্যায়ের একাধিক সহকারী প্রকৌশলী প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, বন্যায় ক্ষতির পর প্রকল্প গ্রহণ করা হলে সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও অবৈধ উপায়ে অর্থ হাতানোর সুযোগ থাকে। যদি টেকসই প্রযুক্তির সড়ক নির্মাণ করা হয়, তাহলে অর্থ কামানোর সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মূলত টেকসই প্রযুক্তির প্রকল্প গ্রহণ করা হয় না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্যার ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে দেশের বিভিন্নস্থানে টেকসই প্রযুক্তির সড়ক নির্মিত হলেও কক্সবাজার জেলায় এই ধরনের সড়ক বা গ্রামীণ অবকাঠামো গড়ে তুলতে আগ্রহ নেই সড়ক নির্মাণে জড়িত সরকারি দুই সংস্থা এলজিইডি এবং সড়ক ও জনপথ দপ্তরের। বন্যা ও জোয়ারের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে রড–সিমেন্ট–কংক্রিট (আরসিসি), ইউনি ব্লক এবং সাবমারসিবল প্রযুক্তির সড়ক নির্মিত হয়েছে দেশের বিভিন্নস্থানে। এতে বেশ সুফলও মিলেছে। কিন্তু কক্সবাজার জেলার বেশকটি উপজেলার সড়ক বন্যা এবং জোয়ারের পানিতে প্রতিবছর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও টেকসই প্রযুক্তির সড়ক নির্মাণে আগ্রহ নেই। উপরন্তু বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক গতানুগতিক কার্পেটিং সড়ক এবং ইট বিছিয়ে দিয়েই বরাদ্দ শেষ করা হয়। ফলে সরকারি বরাদ্দের সড়ক নির্মিত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু টেকসই হয় না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাওড় এলাকায় ব্যাপক বন্যা থেকে বাঁচতে সাবমারসিবল প্রযুক্তির নতুন সড়ক নির্মাণ করেছে সরকার। বন্যার সময় সড়ক ডুবেছিল ঠিকই কিন্তু পানি নামার পর সড়ক সচল ছিল, ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। একইভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যার কবল থেকে বাঁচতে টেকসই প্রযুক্তির ইউনি ব্লকের সড়ক নির্মাণেও সুফল মিলেছে। পাশাপাশি আরসিসি সড়ক নির্মাণ করে আগে থেকেই সুফল মিলেছে বন্যা প্রবণ বিশেষ করে নদী তীরবর্তী সড়কে। কিন্তু কক্সবাজার জেলায় মাত্র কয়েকটি গ্রামীণ সড়কই আরসিসিতে নির্মিত হয়েছে। টেকসই প্রযুক্তির সড়ক নির্মাণের সফলতা বেশ। চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী কতৃক বাস্তবায়িত পৌরশহরের অসংখ্য সড়ক তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

কক্সবাজার–১ আসনের সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম বলেন, বন্যা হলেই লণ্ডভণ্ড হয় পুরো এলাকা। সেই সাথে বিলীন হয়ে পড়ে সড়কগুলো। তাই আমি বারবার বলে আসছি, সড়কগুলোকে টেকসই প্রযুক্তি দ্বারা তৈরি করতে। কিন্তু কেন জানি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সড়ক নির্মাণ করতে সরকারি দপ্তরগুলোর অনীহা। তিনি বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এখন টেকসই প্রযুক্তির দিকে আমাদের ধাবিত হতে হবে। এতে প্রতিবছর বন্যা থেকে রক্ষা পাবে সড়কগুলো। একইসাথে সরকারি টাকার অপচয়ও একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। প্রয়োজনে এই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।

স্থানীয় রাজনীতিবিদ ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরী আরমান বলছেন, এলজিইডি সড়ক ও জনপথ দপ্তরের কর্মকর্তারা বছর দুয়েকের জন্য এখানে পদায়ন হন। ওই সময়ের মধ্যে তারা শুধু রুটিন কাজকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। নতুন চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকি নিতে চান না। এরই মধ্যে কোনো এক কর্মকর্তা উদ্যোগী হলেও পরবর্তী কর্মকর্তা সেটির ধারাবাহিকতা রাখেন না। ফলে টেকসই উন্নয়ন কাগজে–কলমেই থেকে যায়।

স্থানীয় বাসিন্দা মহিউদ্দিন খোকা বলছেন, বন্যার ঝুঁকি এড়াতে কাকারা মিনিবাজার থেকে কাকারা তাজুল উলুম মাদরাসা সড়কটি ইউনি ব্লক দিয়ে টেকসইভাবে নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শওকত ওসমানসহ বেশ দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন। কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি সড়কটি।

এত দাবি–প্রস্তাবের পরও কেন সড়কগুলো আরসিসি–ইউনি ব্লকে রূপান্তর হচ্ছে না জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা প্রকৌশলী সেফায়েত ফারুক চৌধুরী বলেন, আমি এসেছি খুব বেশিদিন হয়নি। এবারের বন্যায় দেখেছি চকরিয়ার ইউনিয়নগুলোর মধ্যে বন্যার তাণ্ডবেরও ভিন্নতা ছিল। কাকারা ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী সড়কে বন্যা সরাসরি আঘাত হেনেছে, সড়কের নিচের বেইজ ধসে গেছে। আবার কোনাখালীতে কিন্তু সড়ক পানিতে অনেকদিন ডুবে থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, আরসিসি, সাবমারসিবল এবং ইউনি ব্লক প্রযুক্তির সড়ক সব ইউনিয়নে একইভাবে নির্মাণ সম্ভব নয়। যেখানে যেটি প্রয়োজন সেভাবেই নির্মাণ করতে হবে। এটা ঠিক টেকসই সড়ক নির্মাণ করতে খরচ কার্পেটিংয়ের তুলনায় একটু বেশি কিন্তু স্থায়িত্ব বেশি।

সেফায়েত ফারুক চৌধুরী বলছেন, আরসিসি ও ইউনি ব্লক সড়কে দুর্বল দিক হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হলে দ্রুত মেরামত করাটা কঠিন। আর গাড়ি চলাচল স্বাচ্ছন্দ্যময়। এজন্য দেখবেন আমরা পুরো সড়ক কার্পেটিং করছি কিন্তু বাজার কিংবা পানি নেমে যাওয়ার স্থানে সিসি ঢালাই করছি। তবে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, কারিগরি টিম যদি জুতসই মনে করে তাহলে সেটিও নির্মাণ সম্ভব।

চকরিয়ার অভিজ্ঞ ঠিকাদাররা জানান, কার্পেটিং নির্মাণের চেয়ে টেকসই প্রযুক্তির সড়ক নির্মাণ খরচ বেশি। যেমন, শুধু এক কিলোমিটার কার্পেটিং নির্মাণ করতে ব্যয় হয় ৮০ লাখ টাকা। বিপরীতে ইউনি ব্লকে নির্মাণ ব্যয় আরো কম ৬৫ লাখ টাকা। আরসিসি ঢালাই সড়কে ব্যয় এক কোটি টাকা।

জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা ঠিকাদার সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, বন্যা ঝুঁকি কমাতে এই উপজেলায় বিশ্বব্যাংকের ডিজাইন (ডিসিটি–৩) অনুযায়ী আরসিসি সড়ক নির্মাণ করা গেলে অনেক বেশি টেকসই হবে। আমি চকরিয়া ও পেকুয়ায় ৩ কিলোমিটার আরসিসি সড়ক নির্মাণ করেছি। বন্যার পর গত পাঁচ বছরেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তিনি বলেন, চকরিয়ায় একটি সড়ক ইউনি ব্লক দিয়ে নির্মাণের দরপত্র ডাকা হয়েছে। কিন্তু কোন টাইপের ব্লক দিয়ে সেটি নির্মিত হবে এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। এরপরও আমরা মনে করি ধাপে ধাপে টেকসই প্রযুক্তির সড়ক নির্মাণের দিকে যাওয়া উচিত বলে জানান।

পাঠকের মতামত: