নিজস্ব প্রতিবেদক :: পেকুয়া উপজেলা নয় পুরো কক্সবাজার জেলা জুড়ে আলোচনা চলছে ১৫ টন চালের হদিস নিয়ে। ‘টক অব দ্যা ডিস্ট্রিক’ হিসাবে ঘটনাটি এখন সবার মুখে মুখে। মহামারী করোনার বিষয়টি আড়াল হয়ে চাল গায়েবের বিষয়টির আলোচনা এখন সর্বমহলে।
এ চাল গায়েবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ছাড়াও উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা জড়িত বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বেশ আলোচনার সৃষ্টি হলেও তাদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ যথেষ্ঠ দূর্বল। তবে ঘটনার আড়ালের ঘটনা তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জোরালো হচ্ছে।
ইতোমধ্যে এঘটনাটি তদন্ত করতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আফসার পেকুয়ায় এসে প্রাথমিক তদন্ত করে গেছেন। কথা বলেছেন উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে।
এদিকে কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র মানুষদের জন্য গত ২৯ জুলাই ২০১৯ সালে ত্রাণ ও দূর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অধিন ৪০ টন চাল বরাদ্ধের সুপারিশ করা হয়। যার স্বারক নং ৫১.০১.২২০০.০০০.৪১.০০৩.১৯.৫৬১। ৪০ টনের এ বরাদ্দটির চেয়ারম্যান করা হয় টইটং ইউপির চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীকে। বিগত সময়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ওই ৪০ টন চাল থেকে ২৫ টন চাল উপ বরাদ্ধের মাধ্যমে বিলি করা হয়। সেই সময়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব উল করিম বাকি ১৫টন চাল রিজার্ভ ফান্ডে রাখেন। যেন দূর্যোগ মূহর্তে হতদরিদ্র মানুষদের মাঝে বিলি করা যায়। ইতোমধ্যে করোনা ভাইরাসের কারণে পেকুয়ার হতদরিদ্র লোকজন অর্থকষ্টে দিনানিপাত করলে তাদের সহায়তার জন্য ওই ১৫ টন চাল বরাদ্ধ দেয়া হয়। গত ৩১ মার্চ ইউএনও সাঈকা সাহাদাত ও প্রকল্প কর্মকর্তা শুভ্রাত দাশের সাক্ষরে ১৫ টন চাল প্রকল্প চেয়ারম্যান টইটং ইউপির চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীকে উত্তোলনের জন্য ডিও দেন। যার স্বারক নং ৩০৮।
সেই স্বারক অনুসারে গত ৬ এপ্রিল পেকুয়া উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা অসিত বরন তালুকদার সাক্ষরিত বিলি আদেশে ৯ এপ্রিল চকরিয়া খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল হাই সাক্ষর করেন। ওই বিলি আদেশে (ডিও) সাক্ষর করে চালগুলো বুঝে নেন টইটং ইউপির চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী। ওইদিন প্রকল্পের চেয়ারম্যান হিসাবে ১৫টন চাল জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীর জিম্মায় চলে যায়। তারপর থেকে ওই ১৫টন চালের হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না।
এবিষয়ে টইটং ইউপির চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী কোন ধরণের বক্তব্য দিতে অপরাগত প্রকাশ করলেও অনুসন্ধানে জানা গেছে, চালগুলো গত ৯ এপ্রিল খাদ্য গুদাম থেকে চেয়ারম্যার জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীর নামে ইস্যু হলেও চালগুলো তার জিম্মা থেকে উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ এক কর্মকর্তার জিম্মায় চলে যায়। যার কারণে চালগুলো হতদরিদ্রদের মাঝে বিলি হয়নি এবং মাষ্টাররোলও জমা হয়নি প্রকল্প কর্মকর্তার কার্যালয়ে। অলিখিত এবিষয়টি এখন মানুষের মুখে মুখে প্রচার হচ্ছে। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ইউএনও সাঈকা সাহাদাত ও চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন স্থানীয় এলাকাবাসী থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের লোকজন।
এঘটনাটি ২৭ এপ্রিল পেকুয়া উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা মোঃ আমিনুল ইসলাম চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী বরাবর একটি পত্র প্রেরণ করেন। যেখানে উল্লেখ করা হয়, হতদরিদ্রদের জন্য দেয়া ১৫টন চাল উত্তোলনের বেশ কয়েকদিন গত হয়ে গেলেও জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী মাষ্টার রোল জমা দেননি। এমনকি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমাও দিতে পারেননি। নির্দেশনা থাকার পরও তিনি মাষ্টার রোল ও কাগজপত্র জমা না করায় অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন।
আরো জানা গেছে, দীর্ঘ ১৯দিন আগে ১৫টন চাল উত্তোলন হলেও প্রকল্প কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম ও সংশ্লিষ্ট ট্যাগ অফিসার চালগুলো এতদিন কোথায় গেল তার কোন ধরণের তদারকি করেননি। অদৃশ্য একটি শক্তির কারণে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যান বলে জানা গেছে।
এদিকে ১৫টন চাল গায়েব বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়লে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তৎবীর শুরু করে উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরা। তবে স্থানীয় কিছু সংবাদকর্মী এবিষয়টি নিয়ে সরব হলে গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন চাল চুরির বিষয়টি নিয়ে তৎপরতা শুরু করে।
একপর্যায়ে চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী ও উপজেলা আ’লীগের যুগ্ন-সম্পাদক বারবাকিয়া হোসনে আরা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি ওয়াহিদুর রহমান ওয়ারেছির মধ্যে একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে একটি করণীয় নির্ধারিত হয়। বৈঠকে হোসনে আরা উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে বরাদ্ধকৃত মাঠ ভরাটের জন্য বরাদ্দকৃত চাল থেকে ১৫টন চাল উত্তোলন করে টইটংয়ে আত্মসাৎ হওয়া ১৫ টন চালের ঘটনা ধামাচাপা দিতে জনগণের মাঝে বিলি করার অনুরোধ করেন চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম। এরই ধারাবাহিকতায় গত রবিবার দিনগত রাতে হোসনে আরা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ১৫ টন চাল মজুদ করেন। বিষয়টি জানতে পেরে তাৎক্ষনিকভাবে র্যাবসহ স্থানীয় প্রশাসন অভিযান চালিয়ে চালগুলো জব্দ করে। এসব চাল ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোস্তফা আলী ও দুই ইউপি সদস্যের কাছে জিম্মায় রাখেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয় প্রকল্পটির সভাপতি ওয়াহিদুর রহমান ওয়ারেছিকে।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তিনি থানা হেফাজতে রয়েছে। তবে ওয়াহিদুর রহমানের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তিনি কোন ধরণের অনিয়মে জড়িত নয়। তিনি সমস্ত ডকুমেন্টস ক্লিয়ার করে চালগুলো উত্তোলন করেছে। একটি মহল বিষয়টিকে প্রতিহিংসাবসত প্রশাসনকে জানিয়ে চালগুলো জব্দ করিয়েছে। এক্ষেত্রে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওয়াহিদুর রহমান ওয়ারেছি টইটং ইউপির চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলামের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে কষ্ট নিজের করে নিয়েছে।
টইটং ইউপির স্থানীয় বেশ কয়েকজন বাসিন্দা জানান, টইটংয়ে করোনা ভাইরাস উপলক্ষে সরকারি ত্রাণ সামগ্রী সুষ্ঠুভাবে বন্টন করার জন্য সুনাম রয়েছে ইউপির চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী। এছাড়াও ব্যক্তিগত তহবিল থেকে খাবার সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন তিনি। ১৫টনের চাল আত্মসাতের ঘটনাটি হতবাক করে দিয়েছে এলাকাবাসীকে। এখানে তাকে বলির পাঁঠা বানিয়ে কেউ একজন খেলেছে। বিষয়টি তদন্ত করে চেয়ারম্যানের সাথে এ ঘটনায় উপজেলা প্রশাসনের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
এবিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ আমিনুল ইসলামের সাথে মোঠোফোনে যোগাযোগ করে ১৫টনের চালের বিষয়ে প্রশ্ন করার সাথে সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এবিষয়টি জানতে ইউএনও সাঈকা সাহাদাতের মোঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মহোদয় পেকুয়ায় এসেছিলেন। চালের বিষয়টি তিনি প্রাথমিকভাবে তদন্ত শুরু করেছেন। চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চাল কোথায় নিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন থেকেও তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তে চাল চুরির বিষয়টি প্রমাণিত হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসন কেউ জড়িত নয়।
পেকুয়া থানার ওসি কামরুল আজম বলেন, বারবাকিয়ার হোসনে আরা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জব্দকৃত চালগুলো নিয়ে তদন্ত চলছে। কি কারণে চালগুলো মজুদ করা হয়েছে তা জানতে স্কুল কমিটির সভাপতি ওয়াহিদুর রহমানকে থানায় আনা হয়েছে।
টইটংয়ে ১৫টন চাল গায়েব করার বিষয়ে কোন ধরণের অভিযোগ থানায় আসেনি জানিয়ে ওসি কামরুল আজম বলেন, যারাই চাল নিয়ে চালবাজি করেছে, তারাই অত্যন্ত খারাপ কাজ করেছে। যদি ঘটনাটি সত্য হয় তাহলে তাদের শাস্তি হওয়া উচিৎ।
পাঠকের মতামত: