ঢাকা,শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

শহরে তীব্র যানজট ট্রাফিক পুলিশের মাসোহারা আদায় অর্ধ-কোটি টাকা

কক্সবাজার প্রতিনিধি :::: asa
তীব্র যানজটের শহর ‘পর্যটন নগরী কক্সবাজার’। এতে মানুষের চরম দূর্ভোগ ও ভোগান্তি পোহাতে হলেও তা লাঘবের কোন উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের। বরং সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক বিভাগে যানজট নিরসনের চেয়ে বেশী ব্যস্ত থাকেন প্রতি মাসে অর্ধ-কোটি টাকা মাসোহারা আদায়ের টার্গেট নিয়ে।
ফলে কক্সবাজার শহরে বিভিন্ন ধরণের অনুমোদন বিহীন অতিরিক্ত গাড়ী চলাচল, প্রধান সড়কের পাশে যত্রতত্র বাস কাউন্টার স্থাপন এবং শহরের অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট সময়সূচী অমান্য করে বড় ধরণের যানবাহন প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজার শহরের অভ্যন্তরে বৈধ-অবৈধভাবে চলাচলকারি বিভিন্ন ধরণের যানবাহন থেকে ট্রাফিক পুলিশ প্রতিমাসে প্রায় অর্ধ-কোটি টাকা মাসোহারা আদায় করে থাকে। এসব টাকা পুলিশের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা, কমিউনিটি পুলিশ ও এক শ্রেণীর সাংবাদিকদের মধ্যে বন্টন করা হয়।
তাছাড়া বিদ্যুৎ চালিত যেকোন যানবাহন চলাচল বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ট্রাফিক পুলিশের প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের (আগের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়) প্রজ্ঞাপন জারি থাকলেও কক্সবাজারে প্রতিনিয়ত তা মানা হচ্ছে না। এমন কি দেশের যেকোন ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনকে বিদ্যুৎ চালিত যানবাহনকে লাইসেন্স না দেয়ারও নির্দেশনা ছিল ওই প্রজ্ঞাপনে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশ অমান্য করে কক্সবাজারের ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ বিদ্যুৎ চালিত যানবাহন চলাচল অব্যাহত রেখে প্রতি মাসে আদায় করছে বিশাল অংকের মাসোহারা।
কোন গাড়ীর চালক বা মালিক ট্রাফিক পুলিশের কাছে মাসোহারা
আদায় করতে না চাইলে নানা কারণ দেখিয়ে তার গাড়ী জব্দ করা হয়। পরে মাসোহারার ৫/১০ গুণ বেশী টাকা আদায় করে গাড়ী ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই গাড়ীর চালক-মালিককে ট্রাফিক পুলিশের কাছে মাসোহারা দিতে হয়।
সূত্র জানায়, কক্সবাজার পৌরসভা কর্তৃক শহরের অভ্যন্তরে চলাচলের জন্য অনুমোদন রয়েছে দেড় হাজার টমটমের (ইজি-বাইক)। কিন্তু শহরের অভ্যন্তরে চলাচলকারি টমটমের সংখ্যা ৮ হাজারের বেশী। এসব গাড়ীর কোন চালকেরই নেই বিআরটিসি কর্তৃক প্রশিক্ষণের সনদ। ফলে অদক্ষ ও প্রশিক্ষণ বিহীন এসব চালকের বেপরোয়াভাবে টমটম চালানো এবং সড়কের উপর অতিরিক্ত গাড়ীর চাপের কারণে শহরের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।
এছাড়া তীব্র যানজটের অন্যতম কারণ নির্দিষ্ট সময়সূচীর পরও শহরের অভ্যন্তরে বড় ধরণের যানবাহন প্রবেশ ও চলাচল করা। কক্সবাজার পৌর কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা রয়েছে পণ্যবাহী বড় যানবাহন রাত ১০ টার পর থেকে সকাল ৯ টা পর্যন্ত শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে এবং পণ্য খালাস করে ছেড়ে যাবে। যাত্রীবাহী বাস প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬ টার পর থেকে পরদিন সকাল ৯ টা পর্যন্ত শহরে প্রবেশ এবং ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু পৌর কর্তৃপক্ষের এ নির্দেশনা অমান্য করে নির্দিষ্ট সময়সূচীর পরও বড় ধরণের যানবাহন শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ ও ছেড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের নির্লিপ্ততার কারণে এসব গাড়ী শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করায় প্রতিনিয়ত যানজটের সৃষ্টি হয়।
এছাড়া শহরের অভ্যন্তরে যত্রতত্র গড়ে উঠা বাস কাউন্টারগুলোও যানজটের অন্যতম কারণ বলে সচেতন মহলের দাবি। শহরের প্রধান সড়কের পাশে কাউন্টারগুলোর বাস দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠা-নামা করায় যখন-তখন সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের।
বিভিন্ন পরিবহন সংগঠন, গাড়ি চালকরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কক্সবাজার শহরের অভ্যন্তরে বৈধ-অবৈধভাবে চলাচলকারি এসব যানবাহন থেকে ট্রাফিক পুলিশ প্রতি মাসে আদায় করছে প্রায় অর্ধ-কোটি টাকা। বৈধ-অবৈধ প্রতিটি টমটম গাড়ী থেকে প্রতি মাসে আদায় করা হয় ৫ শত টাকা। এসব গাড়ী থেকে ট্রাফিক পুলিশ মাসোহারা আদায় করে অন্তত ৪০ লাখ টাকার বেশী। এছাড়া শহরের অভ্যন্তরে প্রতিদিনই প্রবেশ করছে ১ হাজারের বেশী সিএনজি অটোরিক্সা। ট্রাফিক পুলিশের জন্য এসব গাড়ী থেকে মালিক-শ্রমিক সংগঠন প্রতি চালকের কাছ থেকে প্রতি মাসে আদায় করে দেড়-হাজার টাকা। এসব টাকা থেকে ট্রাফিক পুলিশ শ্রমিক সংগঠনের কাছ থেকে ২০ হাজার এবং মালিক সংগঠনের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করে।
এছাড়া বিভিন্ন পরিবহন সংস্থা ও মালিক-শ্রমিক সংগঠন থেকে ট্রাফিক পুলিশ মাসোহারা আদায় করে থাকে। এরমধ্যে ইউনিক পরিবহন সার্ভিস আদায় করে ৫ হাজার টাকা, সোহাগ পরিবহন ৬ হাজার টাকা, হানিফ পরিবহন ৪ হাজার টাকা, সৌদিয়া পরিবহন ৫ হাজার টাকা, এস. আলম পরিবহন ৫ হাজার টাকা, গ্রীণ লাইন সার্ভিস ১০ হাজার টাকা, টিআর পরিবহন ৩ হাজার টাকা, দেশ ট্রাভেলস্ ৫ হাজার টাকা, তিশা পরিবহন ৫ হাজার টাকা, শ্যামলী পরিবহন ২ হাজার টাকা, শাহ আমিন সার্ভিস ৪ হাজার টাকা, নাফ স্পেশাল সার্ভিস ৫ হাজার টাকা, ঈদগাঁও লাইন সার্ভিস ৫ হাজার টাকা, চকরিয়া লাইন সার্ভিস ৫ হাজার টাকা, রামু লাইন সার্ভিস সাড়ে ৩ হাজার টাকা, কক্স লাইন সার্ভিস সাড়ে ৩ হাজার টাকা এবং কক্সবাজার ট্রাক মালিক গ্রুপের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
সূত্রটি আরও জানায়, গত কয়েক মাস আগে উপরোল্লেখিত অংকের টাকার চেয়ে ট্রাফিক পুলিশ আরও বেশী মাসোহারা দাবি করায় অতিরিক্ত অর্থ প্রদানে অনীহা জানিয়ে এবং মাসোহারা আদায় বন্ধের দাবিতে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন কক্সবাজারে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। ধর্মঘট কর্মসূচীর কারণে ট্রাফিক পুলিশ তাদের দাবি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।
বিশ্বস্ত সূত্রটি আরও জানায়, ট্রাফিক পুলিশ কর্তৃক আদায় করা এসব মাসোহারা কক্সবাজার পুলিশ বিভাগের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা, কমিউনিটি পুলিশ ও এক শ্রেণীর সাংবাদিকদের মধ্যে বন্টন করা হয়। এরমধ্যে কমিউনিটি পুলিশ পায় প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা এবং এক শ্রেণীর ৪০ জন সাংবাদিকের মধ্যে বন্টন করা হয় প্রতিজনকে ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত। আদায় করা অবশিষ্ট টাকা জেলা পুলিশের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাসহ ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে ভাগ-বন্টন করা হয়।
কক্সবাজার ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর বজলুর রহমান বিভিন্ন পরিবহন থেকে মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তথ্য প্রমাণ সহকারে কেউ মাসোহারা আদায়ের বিষয়টি দেখাতে পারলে আমি চাকুরী ছেড়ে দেবো। তথ্য প্রমাণ উপস্থাপনের আগে আমি কারো সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করতে রাজী নই।
তবে কক্সবাজার পৌর কর্তৃপক্ষ শহরের অভ্যন্তরে বিদ্যুৎ চালিত যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেয়ায় এ বিষয়ে কিছুই করার নেই জানিয়ে তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের এ ধরণের নির্দেশনার ব্যাপারে আমি অবগত নই।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র মাহবুবুর রহমান বলেন, পৌর কর্তৃপক্ষ শহরের অভ্যন্তরে দেড় হাজার টমটম গাড়ী চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত টমটম চলাচলের কারণে শহরের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত যানজট সৃষ্টি হওয়ায় ট্রাফিক পুলিশকে অসংখ্যবার ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তারা কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
এব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে মঙ্গলবার (২১ জুন) সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ঈদের পর পৌর কর্তৃপক্ষ শহরের অভ্যন্তরে অবৈধ টমটম গাড়ী চলাচল বন্ধ ও যানজট নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।

পাঠকের মতামত: