ঢাকা,বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০২৪

ধুম নেই লবণ চাষিদের মধ্যে

লবণের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া ও বিদেশ থেকে আমদানী করায় খালি পড়ে আছে মাঠ

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া ::
গত কয়েক মওসুমে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত লবণ এখনো মাঠেই পড়ে রয়েছে। তার ওপর সিন্ডিকেট করে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি অব্যাহত থাকা এবং দেশে উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়ায় চলতি উৎপাদন মওসুমে খালি পড়ে আছে বিপুল পরিমাণ জমি। কোন কোন উপজেলায় লবণ উৎপাদনে চাষির মাঠে নামার আনুপাতিক হার একেবারে নগন্য।
দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদনকারী অঞ্চল কক্সবাজারের ৬ উপজেলার বর্তমান চিত্র এটি। এই পরিস্থিতিতে কোন কোন এলাকায় স্বল্পসংখ্যক চাষি লবণ উৎপাদনে মাঠে নামলেও উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কা কাজ করছে তাদের মাঝে। এতে অনেকটাই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাচ্ছে দেশের একমাত্র লবণশিল্প। চাষি, শ্রমিকসহ ওতোপ্রোতভাবে লবণ শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় ১০ লাখ মানুষ লবণ শিল্পকে বাচাতে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ আশা করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমান বাজারে আয়োডাইজ মিশ্রিত লবণ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০-৪০ টাকায়। অথচ মাঠপর্যায়ে এক কেজি লবণের দাম মাত্র ৪ টাকার মতো। সিন্ডিকেটের পকেটে লাভ ঢুকলেও বঞ্চিত হচ্ছে চাষিরা। উৎপাদন খরচের অর্ধেকও দাম পাচ্ছে না তারা। মাঠ থেকে এক কেজি লবণ উৎপাদন খরচ পড়ছে সাড়ে ৬ টাকা। ২০১৭ সালে ‘বাফার স্টক’ গড়ে তোলার জন্য সরকার জাতীয় লবণনীতি-২০১৬ এর আলোকে পদপে নেওয়ার ঘোষণা দিলেও তা কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। তাই লবণ চাষিদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হচ্ছেনা বলে মন্তব্য করেন লবণ সংশ্লিষ্টরা।
সরজমিন কক্সবাজারের চকরিয়ার খুটাখালী ও ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ৭৮২ দ্রোনের বড় লবণমাঠ বহলতলী ঘোনায় গিয়ে দেখা গেছে, ইতোমধ্যে লবণ উৎপাদন মওসুম শুরু হওয়ার প্রায় একমাস অতিবাহিত হচ্ছে। কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার লবণ উৎপাদনে বহলতলী লবণ চাষের জমিতে মাঠেই নামেনি চাষিরা। দিগন্তজোড়া লবণের মাঠ খালিই পড়ে রয়েছে।
বহলতলী ঘোনার লবণ চাষি ডুলাহাজারার বৈরাগীর খিল গ্রামের আবদুল কাইয়ুম চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় গতবছরের উৎপাদিত প্রায় ৩০০০ মণ লবণ এখনো মাঠেই পড়ে রয়েছে। তার ওপর সিন্ডিকেট করে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি অব্যাহত থাকায় বহলতলী ঘোনার বড় লবণমাঠে কোন চাষিই নামেনি লবণ উৎপাদনে। সরকার যদি দেশীয় লবণ শিল্পকে বাচাতে জরুরী পদক্ষেপ না নেয় তাহলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে বিলুপ্ত হবে দেশীয় লবণ শিল্প।’
একইঘোনার লবণচাষি ও আওয়ামী লীগ নেতা শামশুল আলম ও জামিল হোছাইনের মতে, দেশে উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে শিল্প মন্ত্রণালয় অনেকটা পজেটিভ হলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একেবারে উদাসীন। সম্প্রতি শিল্পসচিব কক্সবাজারে এসে লবণ সংশ্লিষ্টদের বৈঠক করে হতাশা কাটাতে পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিলেও তার কোন বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না।
চকরিয়ার বড় লবণমাঠ বহলতলী মৌজার চাষিদের দাবি, ডিসেম্বরে লবণ উৎপাদন মওসুম শুরু হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ শতাংশ চাষি লবণ উৎপাদনে মাঠে নেমেছে। বিগত কয়েকবছর ধরে লবণের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবার লবণ চাষে মাঠে নামতে অনীহা দেখা দিয়েছে চাষিদের মাঝে। এই পরিস্থিতিতে চাষিদের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করায় কক্সবাজারের ঐতিহ্যগত লবণশিল্প ধ্বংসের মুখে নিপতিত হয়ে যাচ্ছে।
কক্সবাজারের মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলার অসংখ্য চাষি বলেন, প্রতিবছর লবণ উৎপাদন মওসুমে চাষিদের মধ্যে ধুম পড়ে যেত মাঠে মাঠে। তারা ব্যস্ত সময় পার করলেও সেই চিরচেনা দৃশ্য এবার নেই।
চাষিরা বলছেন, লবণ উৎপাদনে ব্যয়ের সঙ্গে বিক্রয়ের যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। তাই ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হলে লবণ উৎপাদনে মাঠে নেমে দায়-দেনা বাড়ানোর কোন যৌক্তিকতা নেই।
বাংলাদেশ ুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজার লবণ প্রকল্প কার্যালয় সূত্র মতে, চলতি ২০০০-২০২১ মওসুমে দেশে লবণের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯ দশমিক ৫০ লাখ মেট্টিক টন। তবে গতবছরের উদ্বৃত্ত হিসেবে মজুদ রয়েছে প্রায় ৪ লক্ষ মেট্টিক টন লবণ। গত ১৭ জানুয়ারী পর্যন্ত বিসিকের জরিপ অনুযায়ী চকরিয়া এবং সদর উপজেলার কয়েকটি মৌজা ছাড়া বাকী উপজেলায় লবণ উৎপাদনে মাঠে নেমেছে সবমিলিয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ। তন্মধ্যে গতকাল রবিবার পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৪২ হাজার মেট্টিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। যা গতবছর এইসময়ে প্রায় ৪০ হাজার মেট্টিক টন ছিল।
তবে বিসিকের এই তথ্যে গড়মিল রয়েছে বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম লবণ চাষি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও লবণ ব্যবসায়ী হারুণুর রশিদ। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে প্রতিমণ লবণ বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২০০ টাকা। এই বিক্রিতে শ্রমিকের মজুরিও উঠছে না। মওসুম শুরুর একমাস পেরিয়ে গেলেও চকরিয়ার বহলতলী, ডুলাহাজারা, ষোলহিচ্ছা, দরবেশকাটাসহ বড় বড় মাঠগুলো খালিই পড়ে রয়েছে এখনো। ৩০-৩৫ হাজার টাকা আগাম দিয়ে আমার নিজের ১৭০ কানি জমিতে লবণ চাষে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শঙ্কা কাজ করছে উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে।’
এ ব্যাপারে বিসিক কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমান চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘একমাত্র লবণ উৎপাদনকারী অঞ্চল কক্সবাজারের চাষিরা যাতে মাঠে নামে সেজন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে যেসব সমস্যা রয়েছে তা আন্তঃ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের মাধ্যমে সমাধান করা হবে।’

পাঠকের মতামত: