ইমাম খাইর, কক্সবাজার :: কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, জালিয়াতি ও প্রতারণা শিল্পের পর্যায়ে চলে গেছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে মামলার জট। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় মিথ্যা মামলাকে গলাটিপে হত্যা করতে হবে। প্রয়োজনে মিথ্যা মামলার বাদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, সিভিল জুডিসিয়ারি ধ্বংস হয়ে গেছে। সিভিল মামলায় দীর্ঘসুত্রিতার কারণে নানা কৌশলের আশ্রয়ে ফৌজদারি মামলার দিকে ঝুঁকছে। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে পুলিশ, সিভিল সার্জন অফিস, বিচারকগণকে আরো আন্তরিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
শনিবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে জেলা জজের সম্মেলন কক্ষে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসী কনফারেন্সে জেলা জজ এসব কথা বলেন। ওই সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন।
জেলা ও দায় জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, কক্সবাজার আদালতে প্রায় ৩০ হাজার ইয়াবার মামলা রয়েছে। মার্ডার, এনআই এ্যাক্টের মামলার পরিমাণও বেশি। আদালতে জমে থাকা মামলা নিষ্পত্তি করা দরকার। সে জন্য সবাইকে আরো আন্তরিক হতে হবে।
কক্সবাজারে দায়িত্বের ১১ মাসের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে জেলা জজ বলেন, ভুয়া সিজারলিস্ট করে নিরীহ মানুষদের ফাঁসানো হয়। সঠিক তদন্ত না হওয়ায় নিরীহ মানুষ মামলার শিকার। আদালতে দেয়া সাক্ষীদের একেক রকম বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত। যে কারণে সঠিক বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিচারকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। অবিচার করলে আল্লাহর বিচার থেকে পার পাওয়া সম্ভব নয়। অসত্য বক্তব্য গ্রহণ করা যাবে না। সমস্যাগুলোর গোড়ায় হাত দিতে হবে। একজন অফিসার মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে না। কারণ, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
তিনি বলেন, এটা বঙ্গবন্ধুর দেশ। প্রকৃত ঘটনা ও মামলার বিচার করতে হবে। কোন ‘ভগিজগি’ চলবে না। সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। বয়স জটিলতায় পড়ে অনেক মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
সবাইকে আরো সচেতন হওয়ার অনুরোধ করে জেলা জজ বলেন, টাকার বিনিময়ে মিথ্যা ‘জন্মসনদ’ প্রদানের বিষয়টিও ধরা পড়েছে। জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতারা জড়িত না থাকলে এমনটি হতে পারে না। মামলায় জিততে ‘জন্মসনদ’ জালিয়াতিতে আইনজীবীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগও আছে। এনআইডি জটিলতার কারণেও হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে। জালিয়াতির সুযোগে অনেক প্রকৃত আসামি পার পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে আরো সজাগ না হলেও হয়রানি ও মামলাজট বাড়বে।
মামলার তদন্তে পুলিশের ক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে জানিয়ে জেলা জজ বলেন, দুর্বল মামলা ও তদন্তের কারণে ৭০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। নিরীহ মামলায় অনেক আসামি বছরের পর পর জেল খাটছে। অপরাধ প্রমাণের আগেই যারা শাস্তি ভোগ করছে, তার প্রতিকার কি? মামলা নেয়ার সময় আরো সতর্ক হলে নিরীহ মানুষদের বাঁচানো সম্ভব। কমবে মামলা জট।
আইনজীবী ও বিচারকদের উদ্দেশ্যে জেলা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, একজন আসামিকে ‘শিশু’ উল্লেখ করে জামিন চাইলেই হবে না। স্বশরীরে দেখেশুনে বিচার করতে হবে। কারণ, অনেক বুড়োলোককেই ‘শিশু’ সাজিয়ে জামিন প্রার্থনা করার প্রবণতা আছে। এক্ষেত্রে আইনজীবীদের আরো সতর্ক হওয়া দরকার। গতানুগতিক কথা না বলে কার্যকর বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বিচারকার্যের জন্য যতটুকু আলামত প্রয়োজন তা রেখে বাকিগুলো দ্রুত সময়ে ধ্বংস করে দিতে হবে। না হলে আলামতের অপব্যবহারের সম্ভাবনা থেকে যায়।
কক্সবাজারে প্রায় ২০০ জন ব্যক্তি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে। সেসব ঘটনার মামলায় নারী, শিশুদেরও আসামিরা করা হচ্ছে। আসলে কি সবাই অপরাধী? মামলা নেয়ার সময় দেখেশুনে নিতে হবে। যাতে কারো প্রতি অবিচার না হয়। মামলা নেয়ার সময় মানবিকবোধ থাকা চাই।
সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়, কক্সবাজার জেলায় বিভিন্ন আদালতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিশেষ করে জেলায় মাদক, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও জায়গা জমি সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বেশী।
সম্মেলনে দীর্ঘদিনের মামলা জট কমিয়ে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে পুলিশের সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তা, ডাক্তার ও বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানান জেলা জজ।
সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর সঞ্চালনায় কনফারেন্সে বক্তব্য রাখেন- পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান, র্যাব-১৫ এর মেজর মেহেদি হাসান, বিজিবির কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আলী হায়দার আজাদ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোঃ মোসলেহ উদ্দিন, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ রেজাউল করিম, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মোহাং শাজাহান আলি, অতিরিক্ত জেলা জজ সাবরিনা আলী, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজিব বিশ্বাস, যুগ্ম জেলা জজ সাইফুল ইসলাম, সহকারি সিভিল সার্জন ডাঃ মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর, জেলা বারের সভাপতি এডভোকেট আজম মইন উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জিয়াউদ্দিন আহমেদ, পিপি এডভোকেট ফরিদুল আলম, এডভোকেট বদিউল আলম সিকদার, এডভোকেট একরামুল হুদা, দুদকের পিপি এডভোকেট আবদুর রহিম।
দূরের এলাকা থেকে বেলা ১টার মধ্যে আদালতে আসামি প্রেরণে জটিলতা, পোস্ট মর্টেম প্রতিবেদন পেতে দেরীর কারণে বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ নানা সমস্যার কথা উপস্থাপন করেন বিভিন্ন আদালতের বিচারকগণ। সমস্যাসমূহের সমাধানে জেলা জজ, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তারা।
ইউএনডিপির সহায়তায় কনফারেন্সে আদালতের বিচারকগণ, পুলিশের ৮ থানার ওসিসহ উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসী কনফারেন্সে যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে-
১) তদন্ত ও অনুসন্ধানে অপ্রত্যাশিত বাধা অপসারণ
২) মূলতবী পরোয়ানা জারী ও তামিলে প্রতিবন্ধকতা, যদি থাকে অপসারণ
৩) সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ
৪) সাক্ষীদের আদালতে আগমণ ও ফিরে যাওয়ার নিরাপত্তা
৫) জেল হাজত থেকে বিচারাধীন বন্দিদের সঠিক সময়ে আদালতে উপস্থাপন
৬) হুলিয়া ও ক্রোকী পরোয়ানা দ্রুত জারী
৭) আদালত প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা পদক্ষেপসমূহ, বিচারক এবং জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য নিরাপত্তা
৮) মালখানা থেকে সময়মতো আলামত উপস্থাপন
৯) ফৌজারী বিচার ব্যবস্থায় পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসীর মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা
১০) মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ।
পাঠকের মতামত: