নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া-পেকুয়া ::
চকরিয়া ও পেকুয়া উপকূলীয় এলাকার মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় রক্ষাকবচ হিসেবে পরিচিত অন্তত ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ একেবারেই অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। মাঝেমধ্যে বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও তা টেকসই না হওয়ায় প্রতিবছর সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এখানকার পথ–ঘাট। তবে দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে পেকুয়া উপজেলার মগনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া, করিয়ারদিয়াসহ আশপাশের অন্তত ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বেশ কয়েকমাস আগে থেকে চলছে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ। তন্মধ্যে ২ দশমিক ৮০ কিলোমিটারে মাটির বাঁধের ওপর বসানো হবে সিসি ব্লক। আর বাকী অংশে টেকসই মাটির বাঁধের নির্মাণকাজও চলছে। ইতোমধ্যে কাজের প্রায় ৫০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালের ২৯ এপিলের ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পরদিন কক্সবাজার উপকূলজুড়ে মানুষ আর গবাদি পশুর লাশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। ওই সময় চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন, কারিতাস বাংলাদেশসহ বেসরকারি সংস্থা ও জনপ্রতিনিধিরা অন্তত ১৫ দিনব্যাপী এসব লাশ উদ্ধার করে গণকবর দিয়েছিলেন। ২৬ বছরের ব্যবধানে উপকূলীয় এলাকায় এসব গণকবরের অস্থিত্বও বিলীন হয়ে গেছে। চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় প্রায় ২৫ হাজার নারী–পুরুষের প্রাণের বিনিময়ে ওই সময় দেশি–বিদেশি অর্থায়নে শতাধিক সাইক্লোন শেল্টার নির্মিত হয়েছিল। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন এসব শেল্টারের সিংহভাগই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে চকরিয়া–পেকুয়ার ৫ লাখ মানুষ এখনো বসবাস করছেন চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে।
অপরদিকে, উপকূলীয় এলাকার জনগণকে জলোচ্ছ্বাসের তান্ডব থেকে রক্ষার জন্য চকরিয়ায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়নি বললেই চলে। ফলে বেশীরভাগ উপকূলীয় ইউনিয়ন এখনো অরক্ষিতই পড়ে রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জানমাল রক্ষার জন্য দুই উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (প্যারাবন) সৃষ্টি করা হলেও তা উজাড় করে দুর্বৃত্তরা ঘের তৈরি করে চিংড়ি চাষ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, যে কোনো সময় ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে প্রাণহানি আগের চেয়ে ভয়াবহ হবে। চকরিয়া উপকূলীয় বদরখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খাইরুল বশর বলেন, ‘৯১ সালের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমরা শিক্ষা নিইনি। যখন সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে তখন সংশিহ্মষ্টদের তৎপরতা একটু বাড়লেও মাঝপথে থেমে যায়। এতে বরাবরের মতোই অরক্ষিত থাকে উপকূলের মানুষ।’চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা উপকূলের মানুষ আর অরক্ষিত থাকতে চাই না। বর্তমান সরকারের কাছে এলাকার মানুষের পক্ষে আমার একটাই আবেদন, স্থায়ী এবং টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে রক্ষা করা হয় আমাদের।’ উপকূলীয় পেকুয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ চৌধুরী রাজু বলেন, ‘পেকুয়া উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে মগনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া ও পেকুয়া সদর। তন্মধ্যে একেবারে সাগরগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে মগনামা। উপকূলের মানুষকে রক্ষায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য প্রতিনিয়ত জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে বিগত বছরগুলোতে লিখিতভাবে তাগাদা দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘অনেক ত্যাগ–তিতিক্ষার পর কয়েকমাস আগে থেকে সাগর বেষ্টিত মগনামা ইউনিয়নের জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং ব্লক বসানোর কাজে হাত দেয়। এসব কাজ যাতে টেকসই হয় সেজন্য এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাসহ সংশিহ্মষ্টদের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছি।’
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, কক্সবাজারের উপকূলীয় ৬০ কিলোমিটার এলাকায় বেড়িবাঁধ স্থায়ীভাবে নির্মাণ করতে ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফর্মা (ডিপিপি) তৈরি করে ২৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল ২০১৫ সালে। এর পর ২০১৬ সালের শেষদিকে পেকুয়ার মগনামাসহ কক্সবাজার উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, ‘প্রায় ৬ মাস আগে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও চকরিয়ার কিছু অংশ বর্তমানে পার্বত্য বান্দরবানের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন চলে গেছে।’ পেকুয়ায় পাউবোর কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা উপ–সহকারী প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন জানান, সমুদ্র উপকূলের পেকুয়ার মগনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া, করিয়ারদিয়াসহ আশপাশের প্রায় ২০ কিলোমিটারজুড়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এজন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯০ কোটি টাকা। তন্মধ্যে মাটির বাঁধের ওপর ২ দশমিক ৮০০ কিলোমিটারে বসানো হবে আরসিসি ব্লক। আর বাকী অংশে দেওয়া হচ্ছে টেকসই মাটির বাঁধ। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন ইন্টারন্যাশনাল ও মোস্তফা এন্ড সন্স এই কাজ বাস্তবায়ন করছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে কাজ চূড়ান্তভাবে সমাপ্ত হলে এর সুফল পাবেন পেকুয়া উপজেলার প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ, রক্ষা পাবে উপকূল।
উপ–সহকারী প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘প্রায় ২৫ বছর পর শুরু হওয়া এই কাজ পরিদর্শন করে গেছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী শামছুল করিমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ সময় তিনি কাজের মান নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকেও নির্দেশ দেন গুণগত মান বজায় রেখে টেকসইভাবে কাজ সম্পাদন করতে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও তদারকি বাড়িতে দিতে নির্দেশ দেন প্রধান প্রকৌশলী।’
পাঠকের মতামত: