ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়া থানা নতুন ভবন পেলেও নির্মাণ কাজে শুভঙ্করের ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::

প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন বহুতল ভবনে শুরু হতে যাচ্ছে কক্সবাজারের চকরিয়া থানার কার্যক্রম। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি মাসের যেকোনো সময় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের মাধ্যমে এই নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হতে যাচ্ছে চকরিয়া থানার কার্যক্রম। সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এই থানা ভবনের উদ্বোধন করবেন বলে সম্মতি দিয়েছেন।

এদিকে নতুন ভবনে কার্যক্রম শুরু হতে যাওয়ায় আনন্দে উদ্বেলিত এই থানায় কর্মরত পুলিশ অফিসার ও কনস্টেবলরা। কেননা স্বাধীনতা পরবর্তী দোতলা বিশিষ্ট যে ভবনটিতে বর্তমানে থানার কার্যক্রম চলছে তা অনেকটা ব্যবহার অনুপযোগী। অনেক আগেই এই ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটলেরও সৃষ্টি হয়েছে। ছাদের পলেস্তরা খসে পড়ায় বর্ষা মৌসুমে পানির যন্ত্রণাও ভুগতে হয়েছে থানায় কর্মরতদের। বিশেষ করে কনস্টেবলদের দুর্ভোগ ছিল বেশি। এর পরও এসব যন্ত্রণা সয়ে দায়িত্ব পালন করছেন তারা। অবশ্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত নতুন ভবনে অতি শিগগিরই স্থান হতে যাওয়ায় কনস্টেবলরাই বেশি খুশি। একই সঙ্গে বর্তমান সরকারের সময়ে নতুন থানা ভবন পেয়ে চকরিয়া উপজেলার সাড়ে ৫ লক্ষ মানুষও আনন্দিত।

সরেজমিন দেখা গেছে, বর্তমানে নতুন এই থানা ভবনের অবশিষ্টাংশ কাজ সম্পন্ন করার তোড়জোড় চলছে। দূর থেকে দৃষ্টিনন্দন এই ভবনের দিকে চোখ গেলেই সবার নজর কাড়ছে। বিশেষ করে ভবনের সামনের অংশের দৃশ্য দেখে সাধারণ মানুষ বেশ পুলকিত। তাছাড়া ভবনের একেবারে সামনের অংশে রয়েছে বিশালায়তনের মাঠও। আর সেখানে স্যালুটিং ডাইস এবং তার পাশে ফুলের বাগানটিও এই ভবনের সৌন্দর্য অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে ফুলের বাগান সাজানোর কাজও পুরোদমে শুরু হয়েছে।

এতে আশা করা যাচ্ছে, নতুন এই থানা ভবনটি অনেকের কাছে চিত্তবিনোদনেরও অংশ হয়ে ওঠবে। প্রতিদিন হয়তো অনেক রুচিশীল মানুষ ভিড় করবেন থানা ভবনের সামনের ফুলের সৌরভ নিতে। এজন্য থানার বর্তমান ওসি মো. বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী ও পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. ইয়াছির আরাফাতসহ কর্মকর্তারা যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন ফুলের বাগানকে মনের মতো করে সাজাতে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এই ভবন নির্মাণসহ যাবতীয় কর্ম সম্পাদনের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ভবনের ভেতরের অংশে এমন কিছু সামগ্রী ব্যবহার করেছেন যা একেবারেই নিম্নমানের। বিশেষ করে রুমের মধ্যে লাগানো সিলিং ফ্যানগুলো একেবারে অখ্যাত কোম্পানির। যে কোম্পানির সিলিং ফ্যান এই ভবনে লাগানো হয়েছে তা সচরাচর দেখা যায় না। এ ছাড়াও বিভিন্ন আসবাবপত্রসহ আনুষঙ্গিক ছোট-খাটো সামগ্রীও ব্যবহার হয়েছে নিম্নমানের। এতে এসব সামগ্রীর স্থায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শুধু তাই নয়, এই ভবন নির্মাণকাজের দরপত্রের মধ্যে বাউন্ডারি দেয়াল নতুন করে নির্মাণের জন্য কথা থাকলেও শুভঙ্করের ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। পুরনো বাউন্ডারি দেয়ালের উপরি অংশের কয়েকটি ইট উৎপাটন করে তার ওপর ইটের গাঁথুনি এবং কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে এই বাউন্ডারি দেয়াল নির্মাণের কাজ শেষ করা হয়েছে। বিপরীতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এছাড়াও নতুন ভবনে যাওয়ার জন্য বর্তমান থানা গেট থেকে আরসিসি ঢালাইও দেওয়া হয়নি। এনিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বার বার তাগাদা দিলেও ঠিকাদার তা শুনছেন না।

অভিযোগ রয়েছে, জেলার একজন সংসদ সদস্য মূলত থানা ভবন নির্মাণের এই কাজটি করছেন। আর ওই এমপি তাঁর নিকটাত্মীয় জামায়াত নেতা

মোহাম্মদ আইয়ুবের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই কাজটি বাস্তবায়ন করছেন। এ কারণে পুলিশ কর্মকর্তাদের কোনো কথাই ঠিকাদার শুনছেন না।

এদিকে সম্প্রতি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মোহাম্মদ আইয়ুবের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এই ভবন নির্মাণের বিষয়ে যথাযথ তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। নানা ছুঁতো তুলে তথ্য দিতে গড়িমসি করেছেন এই ঠিকাদার।

এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তাঁর ভাষ্য, বর্তমান সরকার বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয় করে চকরিয়া থানার এই নতুন ভবন নির্মাণ করছেন। ঠিকাদারকে এই ভবন নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়ার সময় নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কত টাকা ব্যয়ে এবং এই ভবনে কী কী সুযোগ-সুযোগ সুবিধা থাকবে তার একটি তথ্য সম্বলিত সাইনবোর্ড লাগাতে। কিন্তু সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

যেসব সুবিধা থাকছে নতুন এই ভবনে : বর্তমানে চকরিয়া থানার কার্যক্রম যে জরাজীর্ণ ভবনে চলছে সেখানে ছিল না কোনো নাগরিক সুবিধা। শিশু ও মহিলা কয়েদির জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এতদিন ধরে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল সকলকে। তবে নতুন ভবনে সবকিছুই আলাদা আলাদাভাবে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে তারা। এই ভবনে রয়েছে আলাদা সার্ভিস ডেলিভারি কক্ষ, ডিউটি অফিসারের কক্ষ, ওয়েটিং রুম, বিশালায়তনের ফোর্স (কনস্টেবল) ব্যারাক ও ডাইনিং, মহিলা কনস্টেবলদের জন্য আলাদা সিঁড়িসহ ব্যারাক ও ডাইনিং, অফিসারদের আলাদা আলাদা কক্ষ, ওসি (প্রশাসন) ও পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) এর জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত বড় পরিসরের কক্ষ। নারী, শিশু এবং পুরুষ কয়েদিদের জন্য বিশালায়তনের আলাদা হাজতখানা। রয়েছে বড় ধরনের একটি হলরুম ও সেমিনার কক্ষ ছাড়াও মুন্সিখানা এবং অস্ত্রাগার।

জানা গেছে, প্রায় চার বছর আগে থেকে নতুন এই থানা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বর্তমানে চারতলা পর্যন্ত পুরোপুরি কাজ শেষ করার তোড়জোড় চলছে। ভবিষ্যতে এই ভবনের ওপরে আরো কয়েক তলা সম্প্রসারণ করা যাবে। এ জন্য প্রায় ১০ তলা ফাউন্ডেশনের কাজ সম্পন্ন এবং ফাইলিং কাজও সম্পন্ন করা হয়।

চকরিয়া থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী জানান, চকরিয়া থানার এই নতুন ভবন উপজেলার সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য হবে। কেননা এই ভবনের প্রতিটা কক্ষ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত। বিশেষ করে শিশু, নারী ও পুরুষের জন্য বিশালায়তনের হাজতখানা রয়েছে। সবকিছুই আলাদা আলাদা করে তৈরি করা হয়েছে এই ভবনে। এখানে থাকবে না কোনো মশার যন্ত্রণা। আধুনিক টয়লেট ব্যবহার করতে পারবে হাজতখানায় আগতরা।

ওসি বখতিয়ার বলেন, ‘শুধু হাজতখানা নয়, এই ভবনের প্রত্যেকটা কক্ষ এবং স্থাপনা আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় ভরপুর। আগের ভবনে জায়গার সংকুলান না হওয়ায় এখানে-ওখানে বসে কার্যক্রম চালাতেন পুলিশ অফিসাররা। নতুন ভবনে সেই সমস্যা তো নেই, অনেক কক্ষ একেবারে খালি পড়ে থাকবে। এই ভবনে অফিসারদের জন্য রয়েছে থাকার সু-ব্যবস্থাও। নারী এবং পুরুষ কনস্টেবলদের জন্য রয়েছে একেবারেই আলাদা ব্যারাক এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। সবকিছু মিলিয়ে থানার এই নতুন ভবনটি সকলের জন্য হয়ে উঠবে চিত্তবিনোদনের একটি অংশ। সেজন্যই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

এ ব্যাপারে চকরিয়া সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার কাজী মোহাম্মদ মতিউল ইসলাম বলেন, ‘চকরিয়া উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের জন্য একেবারেই সুখবর থানার এই নতুন ভবন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি অক্টোবর মাসের যেকোনো দিন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হবে থানার নতুন এই ভবন। এজন্য মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এই ভবন উদ্বোধনের জন্য সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন।’

পাঠকের মতামত: