এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া :: নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে চতুর্থধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করেছে। এরই অংশহিসেবে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার অবশিষ্ঠ ৮টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৩ ডিসেম্বর। উক্ত নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ তথা নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হচ্ছেন একাধিক আওয়ামীলীগ নেতা। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে আছেন নৌকার টিকেটে গেল নির্বাচনে বিজয়ী চেয়ারম্যান ছাড়াও দলের বিদ্রোহী অনেক প্রার্থী। আবার মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেকের বিরুদ্ধে আছে ম্যারাথন অভিযোগও। বলা চলে অনুষ্ঠিতব্য চতুর্থধাপের নির্বাচনে নৌকার মাঝি হতে ইচ্ছুক চকরিয়া উপজেলার অবশ্লিষ্ট আট ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের অনেক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই।
জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের তফসিলের আলোকে চকরিয়া উপজেলার আট ইউনিয়ন যথাক্রমে ফাসিয়াখালী, বরইতলী, হারবাং, বমুবিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, চিরিঙ্গা, ডুলাহাজারা ও খুটাখালী ইউনিয়নে আগামী ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে চতুর্থধাপের নির্বাচন। বর্তমানে উল্লেখিত ৮ ইউনিয়নে নির্বাচিত ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের বর্তমান চেয়ারম্যান ছাড়াও গেল নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভোটযুদ্ধে থাকা একাধিক প্রার্থী নৌকার টিকেট পেতে জোর চেষ্ঠা তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন দলের উপজেলা জেলা এমনকি আওয়ামীলীগের হাইকমান্ডে।
জানা গেছে, চকরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী টানা চারবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন ফাসিয়াখালী ইউনিয়নে। তিনি এবারও চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী এটা পরিস্কার। তবে এই ইউনিয়নে তিনি বারবার প্রার্থী হওয়ায় দলে নতুন নেতৃত্বের বিকাশ ঘটছেনা বলে অভিযোগ তৃনমুল নেতাকর্মীদের। তবু তাঁর পাশাপাশি এবার আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী বলে জানিয়েছেন চকরিয়া উপজেলা যুবলীগের সিনিয়র সদস্য হেলাল উদ্দিন হেলালী।
২০০৩ সালে বমুবিলছড়ি ইউনিয়নকে বিভক্তি করে সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেই থেকে গত তিনটি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামীলীগের প্রার্থী চকরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক আজিমুল হক আজিম বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। একসময় ইউনিয়নটি বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিতি থাকলেও বর্তমান চেয়ারম্যান আজিমুল হক সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা পৌঁছে দিয়ে এলাকার গণমানুষের কাছে যেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, তেমনি বিএনপির সেই দুর্গ ভেঙ্গে সুরাজপুর-মানিকপুরকে নৌকার ঘাঁিট হিসেবেও তৈরী করেছেন। এর প্রমাণ মিলেছে, ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়াও গত তিনটি সংসদ নির্বাচন এবং দুইটি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এই ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে নৌকার নিরস্কুশ বিজয়ের মধ্যদিয়ে।
জানা গেছে, বৃহত্তর চকরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের প্রয়াত যুগ্ম আহবায়ক নুরুল হক চেয়ারম্যানের ছোটভাই বর্তমান চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম এবার নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী। স্থানীয় জনসাধারণ ও দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে তিনি একজন ক্লিনইমেজের প্রার্থী হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেছে।
তবে এই ইউনিয়নে এবারও নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশা করেছেন চকরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের আহবায়ক রোস্তম শাহরিয়ার। অবশ্য গেল নির্বাচনে তিনি দলীয় সিদ্বান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে ভোটযুদ্ধে ছিলেন। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকলেও দেশে ফিরে তিনি এখন এলাকায় সক্রিয় রয়েছেন।
চিরিঙ্গা ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের টিকেট পেতে চান দুই প্রার্থী। একজন তিনবার নির্বাচিত বর্তমান চেয়ারম্যান ও চকরিয়া উপজেলা কৃষকলীগের সভাপতি জসীম উদ্দিন এবং অন্যজন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি জামাল হোসেন চৌধুরী। বর্তমান চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিনের বিরুদ্ধে বড়ধরণের কোন অভিযোগ না থাকলেও মনোনয়ন প্রত্যাশী অপর প্রার্থী জামাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে গেল নির্বাচনে দলীয় সিদ্বান্ত উপেক্ষা করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে ভোটযুদ্ধে ছিলেন এমন অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও তিনি সম্প্রতিসময়ে বেশ কটি বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে বেশ সমালোচিতও হয়েছেন।
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দাবি, সম্প্রতিসময়ে উপজেলার চিংড়িজোনের চিরিঙ্গা মৌজায় নোবেল বিজয়ী ড.ইউনুছের মালিকানাধীন গ্রামীণ ব্যাংকের সাড়ে তিনশত একর আয়তনের একটি চিংড়িঘের দখলের ঘটনা ঘটেছে।
আর এ ঘটনায় আওয়ামীলীগ সভাপতি জামাল চৌধুরী ও তাঁর লোকজন জড়িত বলে গ্রামীণ বাংকের কর্মকর্তারা অভিযোগ তুলেছেন। ওই ঘটনায় চকরিয়া থানায় ৪৪জনের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। এছাড়াও প্যারাবন নিধন করে চিংড়িঘের তৈরীর অভিযোগে উপকুলীয় বনবিভাগ চকরিয়া আদালতে অন্তত ৯টি মামলা করেছে। এসব মামলায় জামাল চৌধুরী ছাড়াও একাধিক ব্যক্তিকে আসামি করেছে বনবিভাগ।
২০১৬ সালের নির্বাচনে হারবাং ইউনিয়নে নৌকার টিকেটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি মিরানুল ইসলাম মিরান। তিনি প্রথমদিকে ভালো করলেও দুইবছর আগে থেকে নানাধরণের অপকর্মে জড়িয়ে দলের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এমন অভিযোগ স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের। তাদের দাবি, ২০২০ সালের আগস্ট মাসে গরু চুরির অপবাধে ইউনিয়ন পরিষদের আটকে রেখে মা-মেয়েকে রশিতে বেঁেধ নির্যাতনের ঘটনায় শুধু চকরিয়া কক্সবাজার নয়, সারাদেশে বেশ আলোচিত সমালোচিত হন চেয়ারম্যান মিরান। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।
হারবাং ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, চেয়ারম্যান মিরানের বর্বরোচিত এই ঘটনায় আওয়ামীলীগের ভাবমূতি চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়। এছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে হারবাং মাজারের খাদেমকে নির্যাতন, তাঁর পরিবারকে হয়রাণি এবং বিচারপ্রার্থী বৃদ্ধাকে মারধরের অভিযোগও আছে। উল্লেখিত ঘটনায় মামলা করেছে ভুক্তভোগীরা।
এছাড়া তিনি পরিষদের গ্রাম আদালতে বিচারকার্য চলাকালে বিচারপ্রার্থীদের গালি-গালাজ এমনকি হাত তুলতেও দ্বিধা করেনা। এসবের পরও তাঁর বিরুদ্ধে বনবিভাগের জায়গা অবৈধভাবে দখলের অভিযোগও আছে বলে দাবি করেন আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীরা।
নিজের করা অপকর্মের কারণে আলোচিত সমালোচিত হলেও এবারের নির্বাচনে চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম মিরান আবারও নৌকার টিকেট পেতে চান। এছাড়া হারবাং ইউনিয়নে এবার নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন ক্লিন ইমেজের অধিকারী সাবেক ছাত্রনেতা ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেরাজ উদ্দিন মিরাজ। তিনি ইতোমধ্যে দলীয় মনোনয়ন পেতে আওয়ামীলীগের সর্বমহলের যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। পাশাপশি এলাকায় সাধারণ জনগন ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে তাঁর প্রার্থীতা হবার প্রচেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়াও হারবাং ইউনিয়নে এবার নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতা পরিমল বড়ুয়া। চেয়ারম্যান প্রার্থী হবেন এই আশা থেকে পরিমল বড়ুয়া তিনি বিগত কয়েকবছর ধরে এলাকায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসুচিতে সময় দিচ্ছেন। এলাকার সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করছেন। ইউনিয়নে প্রায় ৬ হাজার হিন্দু বৌদ্ধ ও রাখাইন সম্প্রদায়ের ভোটার রয়েছে। নৌকার টিকেটে হাতে পেলে রির্ভাজ এসব ভোট ব্যাংকের বদৌলতে পরিমল বড়ুয়াকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে বেগ পেতে হবেনা এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন দলীয় নেতাকর্মী এবং অভিজ্ঞ মহল।
চতুর্থধাপের নির্বাচনে বরইতলী ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হচ্ছেন সাবেক চেয়ারম্যান ও কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য এটিএম জিয়াউদ্দিন চৌধুরী জিয়া। তিনি এবারও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন এটি শতভাগ নিশ্চিত। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের দাবি, দলের উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী হিসেবে ভোটের মাঠে থাকায় গেলবারের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী জিয়াউদ্দিন চৌধুরীকে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হতে হয়েছে।
ডুলাহাজারা ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আছেন চারজন। তাঁরা হলেন চকরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মোক্তার আহমদ চৌধুরী, যুগ্ম সম্পাদক সাবেক ছাত্রনেতা শাহনেওয়াজ তালুকদার, আওয়ামীলীগ নেতা কলিম উল্লাহ কলি ও ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক হাসানুল ইসলাম আদর। তাদের মধ্যে কলিম উল্লাহ কলি ও হাসানুল ইসলাম আদর বছরধরে এলাকার উন্নয়নে নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছেন। তবে দলীয় মনোনয়ন তথা নৌকা টিকেট পেতে সবাই সমানতালে চেষ্ঠা করছেন।
স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীর দাবি, চেয়ারম্যান প্রার্থী কলির বাবা হাজী জামাল হোছাইন ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি। জেঠা কামাল হোসেন চেয়ারম্যান ছিলেন অবিভক্ত চকরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি, আর দাদা প্রয়াত মফজল আহমদ ছিলেন ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদের দুইবারের চেয়ারম্যান। ২০১৬ সালের নির্বাচনে জামাল হোছাইন নৌকার মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কয়েকমাস আগে তিনি মারা গেছেন।
এদিকে আওয়ামী পরিবার, অন্যদিকে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের প্রয়াত সভাপতি বাবার বদলে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ছেলে কলিম উল্লাহ কলিকে প্রার্থী করবেন এমন ধারণা করছেন দলের নেতাকর্মীরা।
অন্যদিকে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক হাসানুল ইসলাম আদর ইতোমধ্যে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হচ্ছেন ঘোষনা দিয়ে এলাকায় ব্যাপক কর্মসুচিতে সময় দিচ্ছেন। তিনি চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সাংসদ আলহাজ জাফর আলমের আস্থাভাজন হিসেবে অধিক পরিচিত।
তবে তিনি বেশ কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে দলের মধ্যে সমালোচিত হয়েছেন। বিশেষ করে গত পৌর নির্বাচনের সময় চকরিয়া পৌরসভা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আতিক উদ্দিন চৌধুরীকে শাররীকভাবে লাঞ্চিত করার ঘটনায় কক্সবাজার জেলা যুবলীগ তাকে যুবলীগ থেকে বহিস্কারও করেন।
উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আছেন বর্তমান সভাপতি আলহাজ জয়নাল আবেদিন। তিনি অবশ্য গেল নির্বাচনে দলীয় সিদ্বান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। এবার নতুন করে দলের মনোনয়ন চাইছেন আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাবেক ছাত্রনেতা বেলাল আজাদ। পাশাপাশি মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আছেন গতবারের নৌকার প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহসভাপতি বাহাদুর হকসহ একাধিক নেতা। উপজেলার দুর্গম ইউনিয়ন বমুবিলছড়িতে নৌকার মাঝি হতে চান চারজন। তাদের মধ্যে আছেন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধে চকরিয়ার প্রথম শহীদ আবদুল হামিদের ভাই মনজুর কাদের ও গত নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী কফিল উদ্দিন।
পাঠকের মতামত: