নিজস্ব প্রতিবেদক :: কক্সবাজারের চকরিয়ার মাতামুহুরী নদীতে ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে। এতে নদীর দুই তীরের প্রতিরক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।
চকরিয়ার মাতামুহুরী নদীর দুই তীরে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন লাখো মানুষ। প্রতি মৌসুমে এখানকার চাষিরা জোগান দেন পাঁচ কোটি টাকার বেশি শীতকালীন সবজি ও খাদ্যশস্য। নদীর পাশে আছে শতকোটি টাকার চিংড়ি ও মৎস্য খামার। একটা সময় মাতামুহুরী চাষিদের কাছে আশীর্বাদ হলেও এখন ভর করছে আতঙ্ক। কারণ, নদীতে যত্রতত্র মেশিন বসিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। এতে নদীর দুই তীরের প্রতিরক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। বিলীন হচ্ছে বসতি।
বালু উত্তোলনের ফলে নদীর ওপর তৈরি চারটি সেতু ও একটি রাবার ড্যাম ঝুঁকিতে পড়েছে। বালু উত্তোলন বন্ধ করে যোগাযোগ স্থাপনা রক্ষার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপজেলা প্রশাসনকে তাগাদা দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না। যাঁরা নদী থেকে বালু তুলছেন, তাঁরা কমবেশি সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী। গতকাল সরেজমিনে পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে।
বান্দরবানের লামার মাইভার পর্বত (মিয়ানমার সীমান্ত) থেকে উৎপত্তি মাতামুহুরীর। এরপর সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথে নদীটি বান্দরবানের লামা, আলীকদম ও কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৭০ কিলোমিটার। এর মধ্যে চকরিয়া উপজেলায় পড়েছে ৪০ কিলোমিটার। তবে পেকুয়া, লামা ও আলীকদমের ১৩০ কিলোমিটারে বালু উত্তোলন নেই।
চকরিয়ার ১৪ পয়েন্টে বালুবাণিজ্য ::
চকরিয়া উপজেলার গোবিন্দপুর পশ্চিমপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, উত্তোলন করা বালুর স্তূপ পড়ছে পাশের ফসলি জমিতেই। স্থানীয় লোকজন জানান, পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মেহের আলী কয়েক মাস ধরে বালুবাণিজ্য চালিয়ে আসছেন।
জানতে চাইলে মেহের আলী বলেন, এই বালু তিনি নির্মাণাধীন রেললাইনে সরবরাহ করছেন। চকরিয়ার ইউএনওর কাছ থেকে তিনি অনুমতি নিয়েছেন। তবে এর বিপরীতে কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।
গোবিন্দপুর পশ্চিমপাড়ায় বালু তুলছেন বরইতলী ইউপি সদস্য নিয়াজুল ইসলাম ওরফে বাদল। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
মাতামুহুরী সেতুর নিচে ভরাট চর কেটে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে ২০-৩০ ট্রাক বালু। চকরিয়া পৌরসভার তরছপাড়ায় তিনটি পয়েন্টে ড্রেজার বসিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। এখান থেকে দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে বেতুয়া বাজার এলাকার নির্মাণাধীন রেললাইন সেতুর দুপাশ থেকেও বালু তোলা হচ্ছে।
সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করে স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীর ভাঙারমুখ, বাটাখালী, কাজীরপাড়া, মরংঘোনা সেতুর পশ্চিম পাশে, বাঘগুজারা রাবার ড্যামের পাশসহ অন্তত ১৪টি পয়েন্টে মেশিন বসিয়ে তোলা হচ্ছে বালু।
স্থানীয় সাংসদ ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম দাবি করেছেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীরা আওয়ামী লীগের কেউ নন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১২৬ কিলোমিটারের রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয়। স্থানীয় লোকজন বলেন, রেললাইনের কাজ শুরুর পর থেকে মাতামুহুরীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলনের হিড়িক পড়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে ১৪টি পয়েন্টে অন্তত ২০ লাখ ঘনফুট বালু মজুত আছে। প্রতি ট্রাক বালু বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ থেকে ৭০০ টাকায়। সরকারি হিসাবে প্রতি ঘনফুট বালুতে রাজস্ব দিতে হয় ৩৫ টাকা। এ হিসাবে ২০ লাখ ঘনফুট বালুতে সরকারের ৭ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার কথা।
চকরিয়ার ইউএনও নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান বলেন, ‘নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলনের অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি। তারপরও যেখানে বালু উত্তোলনের খবর পাচ্ছি, সেখানে অভিযান চালানো হচ্ছে। অতিসম্প্রতি বালু উত্তোলনের একটি মেশিন জব্দ ও আরেকটিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’
ঝুঁকিতে ৪টি সেতু
মাতামুহুরী নদীর লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের হাজীপাড়া থেকে চকরিয়া পৌরসভার আবদুল বারিপাড়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজিং করছে ঢাকার এস এস মেশনট্যাক জেবি নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নূরে বশির বলেন, ২০১৮ সালের মার্চে শুরু হয় ৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকার এই ড্রেজিং। শেষ হবে ২০২০ সালের ৩০ জুন। ইতিমধ্যে নদীর এক কিলোমিটার থেকে তাঁরা তুলেছেন ৮৫ হাজার ঘনফুট বালু। এর বিপরীতে সরকারকে রাজস্ব দিয়েছেন ২০ লাখ টাকা। কিন্তু নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে যাঁরা অবৈধ ও অপরিকল্পিতভাবে বালু তুলছেন, তাঁরা সরকারকে কোনো রাজস্বও দিচ্ছেন না, আবার তাঁদের কাজেও ক্ষতি করছেন।
পাউবো চকরিয়া উপসহকারী প্রকৌশলী তারেক বিন ছগির বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু বালু উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না। ফলে পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙে পড়ছে। ঝুঁকিতে রয়েছে মাতামুহুরী, বেতুয়া বাজার, বাটাখালী, কোনাখালীর মরংঘোনা সেতুসহ বাঘগুজারা রাবার ড্যাম। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেনও বললেন, ‘নদী থেকে বালু উত্তোলনের অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি। কারা উত্তোলন করছে, খতিয়ে দেখব।’
পাঠকের মতামত: