বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। সমুদ্র সৈকতের তীরঘেষে জাতির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ২৪২ হেক্টর জমিতে গড়ে উঠেছিল নয়নাভিরাম ঝাউবিথী। এই ঝাউবিথী একসময় এসে পর্যটকদের বিশ্রাম ও প্রকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগের স্থানে রূপ নেয়। কিন্তু কালক্রমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের জোয়ারের আগ্রাসী ভাঙনে বিলীন হতে বসেছে দৃষ্টিনন্দন এ ঝাউবিথী। গত দুই মাসে সাগরে বিলীন হয়ে গেছে সৈকতে ঝাউবীতির দুই হাজারেরও বেশী গাছ। আর গত কয়েক বছরে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পূর্ণিমা ও অমাব্যসার জোয়ারে বিলীন হয়ে গেছে আরো প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষাধিক ঝাউগাছ।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, ১৯৭১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ২৪২ হেক্টর জমিতে ঝাউগাছ রোপন করা হয়। সেই থেকে ৯ দফায় শহরের ফদনার ডেইল টুইট্যার মাথা থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার সৈকতের ২৪২ হেক্টর জমিতে প্রায় ৬ লক্ষ ৫ হাজার ঝাউগাছ লাগানো হয়েছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পূর্ণিমা ও অমাব্যসার জোয়ারে এরইমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষাধিক ঝাউগাছ।
কক্সবাজার সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, পূর্ণিমার জোয়ারে সাগরের পানি ফুঁসে উঠেছে। স্বাভাবিকের চেয়ে যা ৩/৪ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। জোয়ারের পানির প্রবল স্রোত ও উত্তাল ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে। এতে ভেঙে যায় কক্সবাজার সৈকতের অনেক এলাকা। বিশেষ করে নাজিরারটেক, সমিতিপাড়া, ডায়াবেটিক পয়েন্ট, কবিতা চত্বর, শৈবাল পয়েন্ট ও সী ইন পয়েন্টের ভাঙ্গন মারাত্বক রূপ নিয়েছে। ভেঙ্গে গেছে ঝাউবীথির মাঝ দিয়ে পর্যটকের হাটার রাস্তাটিও।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের (সদর) রেঞ্জ কর্মকর্তা তাপস কান্তি পাল জানান, সাগরের গ্রাস থেকে কক্সবাজার সৈকতের দৃষ্টিনন্দন ঝাউবিথী কিছুতেই রক্ষা করা যাচ্ছে না। গত দুই মাসে দুই হাজারেরও অধিক ঝাউগাছ বিনষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে বনবিভাগের সংগ্রহে রয়েছে ৮২৯টি গাছ। সৈকতের সমিতিপাড়া, ডায়াবেটিক হাসপাতাল এবং কবিতা চত্বর পয়েন্টে আরও ৫ শতাধিক ঝাউগাছ হেলে পড়েছে।
সমিতিপাড়ার বাসিন্দা ও কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আকতার কামাল জানান, কয়েক বছর ধরে অব্যাহত ভাঙনে দৃষ্টিনন্দন এ ঝাউবনের অল্প কিছু অবশিষ্ট রয়েছে। যা রয়েছে তাও এই মৌসুমে রক্ষা হবে কি-না সন্দেহ।
বলাকা হ্যাচারির মালিক নজিবুল ইসলাম জানান, সৈকতের তীরঘেঁষে নির্মিত হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট, হ্যাচারি, বাড়িঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনার মালিকরা সমুদ্রের ভয়ঙ্কর রূপ দেখে আতঙ্কিত। উদ্বিগ্ন তাদের বিনিয়োগ নিয়েও। প্রায় পাঁচশ কোটি টাকা বিনিয়োগে সৈকতের তীরজুড়ে স্থাপিত ৫৮টি হ্যাচারি শিল্পেও দেখা দিয়েছে গভীর হতাশা। কয়েকটি হ্যাচারি ভাঙন ঠেকাতে ইতিমধ্যে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে পাথরের বাঁধ দিয়েছে। তাতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
তিনি জানান, হিমছড়ি থেকে পেঁচারদ্বীপ পর্যন্ত এলাকায় মেরিন ড্রাইভ রোড চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
সেভ দ্যা নেচার অব বাংলাদেশ এর পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, ঝাউবনের শিকড় অগভীর। তাই এটি বালুর গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে জোয়ারের পানিতে ভেঙ্গে পড়ে। সমুদ্র সৈকতে যদি সুগভীর মূলের কোন গাছ লাগানো হয় তবে ভাঙ্গন কমানো সম্ভব হবে।
এদিকে কক্সবাজার শহরকে সাগরের ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য তিন বছর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ২৬৫ কোটি টাকা প্রস্তাবিত ব্যয় বরাদ্দে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও এটির কাজ এখনো শুরু হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের জুন মাসে প্রকল্পটি ‘একনেক’ থেকে সংশ্লিষ্ট দফতরে ফেরত পাঠানো হয়। ৬টি দফতরকে সংশ্লিষ্ট করে নতুন করে প্রকল্পটির প্রাক্কলন তৈরির জন্য বলা হলেও গত এক বছরেও কক্সবাজারে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো এ প্রকল্পের পরিকল্পনা ও প্রাক্কলন তৈরি করতে পারেনি। ফলে এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন সংশয় দেখা দিয়েছে।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শবিবুর রহমান জানান, শহর রক্ষা বাঁধ প্রকল্পটি আগামী একনেকের সভায় আবারও উপস্থাপন করা হবে।
পাঠকের মতামত: