ইমরান হোসাইন. পেকুয়া :::
বাদশা মিয়া। বয়স পঞ্চান্ন ছুঁই ছুঁই। পেকুয়া উপজেলার ঘুর্নিঝড় রোয়ানু আক্রান্ত অন্যতম দুর্গত এলাকা রাজাখালী ইউনিয়নের বকশিয়া ঘোনা ও বদি উদ্দীন পাড়ার মাঝামাঝি বাড়ি তার। দুই মেয়ে ও দুই ছেলের জনক তিনি। বছর খানেক আগে বড় মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন সুদূর রাঙ্গামাটিতে। মেয়ের জামাই কাঠ ব্যবসায়ী। স্বামীর সংসারে ভালোই আছে এই মেয়ে। অপর মেয়ে প্রতিবন্ধী। তার চিকিৎসা খরচসহ যাবতীয় ভরনপোষন চালিয়ে যাচ্ছেন বাবা বাদশা মিয়া। সব বাবারা এমনই হয়। সন্তান কখনো তাদের কাছে বোঝা নয়। যেমনটি জানালেন তিনিও।
এর পরের দুই সন্তানই ছেলে। দু’জনই শিক্ষার্থী। বড় ছেলে মোহাম্মদ আলমগীর। রাজাখালী এয়ার আলী খান আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। ছোট ছেলে মোহাম্মদ হোসেন স্থানীয় এলাহেদিয়া এবতেদায়ী মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বাদশা মিয়া এক জনই।
লবন চাষের মৌসুমে এক একরের একটু বেশী(৩কানি) জমিতে লবন চাষ করেন বাদশা মিয়া। মৌসুম শেষে বছরের বাকিটা সময় দিনমজুর হিসেবে অন্যের কাজ করেন তিনি। লবন চাষের মুনাফা আর দিনমজুরির আয়, এ দু’আয়েই তার সংসার বেশ চলে যায়। কখনো কখনো বিবিধ কারণে দেনাগ্রস্থ হলেও বছর ঘুরতে তার আর দেনা থাকে না। কিন্তু গেল বছর মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে কিছুটা দেনাগ্রস্থ হন তিনি। এ মৌসুমে লবন চাষের লাভের টাকায় পাওনাদারের দেনা মিটিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার সেই আশায় গুড়েবালি। ঘুর্নিঝড় রোয়ানু কেড়ে নিয়েছে তার সকল আশা। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার সময় শুধুমাত্র পরণের কাপড় ছাড়া অবশিষ্ট কোন সহায়-সম্পদ অক্ষত নেই।
ভেঙ্গে গেছে বসতঘর, তলিয়ে গেছে উৎপাদিত লবন, জলোস্বাসের পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে গৃহস্থালি সকল জিনিসপত্র। সাথে পরিবারের বেঁচে থাকার সকল অবলম্বনও। তার ওপর বেড়িবাঁধ সাগরবক্ষে বিলীন হয়ে যাওয়ায় নিয়মিত জোয়ার-ভাটা চলছে এসব ইউনিয়নে। বলতে গেলে, না খেয়ে মরার উপক্রম হয়েছে তাদের। এ মিছিলে শুধু বাদশা মিয়া একা নয়। তার পরিবারের মত উপজেলার চার ইউনিয়নের আরো আট হাজার পরিবারের একই অবস্থা। খেয়ে, না খেয়ে দিনানিপাত করছে প্রত্যেকটি পরিবার।
প্রসঙ্গত, পেকুয়া উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ আঘাত হানার ছয়দিন পেরিয়ে গেছে। কয়েকঘন্টার এ দুর্যোগে লন্ডভন্ড হয়ে পড়া উপজেলার চার ইউনিয়ন মগনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া ও পেকুয়া সদরের ঘরবাড়ি হারানো প্রায় দুই হাজার পরিবারের আট হাজার মানুষ এখন সীমাহীন কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। কোথাও ত্রাণ হিসেবে শুকনো খাবার ও চাল বিতরণের খবর শুনলেই দুর্গতরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। আর তাদেরকে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরা। এ অবস্থায় খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে। কিন্তু তেমন ত্রাণ তৎপরতা চোখে না পড়ায় তারা বিব্রত ।
সরেজমিন পেকুয়া উপজেলার মগনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া ও পেকুয়া সদর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, এ চার ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি গ্রামের মানুষ দুর্বিষহ অবস্থায় জীবন-যাপন করছেন। ঘূর্ণিঝড়ের তন্ডবে বসতবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্থ হয়ে খাঁ খাঁ করছে ভিটে। এপাড়া থেকে ওপাড়া যেদিকেই চোখ যায় শুধু দেখা মিলবে ক্ষতচিহ্ন ও দুর্ভোগের চিত্র। এ অবস্থায় শিশুসহ পরিবার সদস্যদের নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো।
রোয়ানুর তন্ডবে বসতবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্থ হওয়া মগনামা ইউনিয়নের শরৎঘোনা গ্রামের আবদুল মালেকের পুত্র কাইছার উদ্দিন বলেন, ‘সেদিন (২১মে)সকাল ৯টার দিকে বাতাস শুরু হলে বাড়ি তালাবদ্ধ করে পরিবারের সদস্যসহ পার্শ্ববর্তী সাইক্লোন শেল্টারে গিয়ে আশ্রয় নিই। কিন্তু কয়েকঘণ্টা পর এসে দেখি পুরো বাড়িটাই বিধ্বস্থ হয়ে গেছে, বাড়ির চালা পর্যন্ত উপড়ে গেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার পরিবারে দুই শিশুসহ ৮সদস্য রয়েছে। কিন্তু ভিটের ওপর বাড়ি না থাকায় মাথা গোঁজারও ঠাঁই হচ্ছে না। তার ওপর বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে যাওয়ায় সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে দুর্ভোগ আরো চরমে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় ৬দিন ধরে এখানে-ওখানে রাত কাটাচ্ছি, চুলোয় আগুন না জ্বলায় হাঁড়িও চড়েনি এতদিন। শুকনো খাবার খেয়েই দিন পার করছি।’ একই কথা জানালেন বসতবাড়ি হারানো পাশের বাসিন্দা মৃত অজি উদ্দিনের স্ত্রী রাবেয়া আক্তার, পশ্চিম বাজার পাড়ার এবাদুল্লাহর পুত্র আবু তাহেরসহ এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ।
রাজাখালী ইউনিয়নের বকশীঘোনা গ্রামের নুরুল আলমের পুত্র আজাহার উদ্দিন, বাদশা মিয়ার পুত্র মোঃ ইউনুছ ও মহিউদ্দিন, মোঃ শরীফের পুত্র মোস্তাক আহমদ ও ছৈয়দ নূর বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের ছোবলে বসতবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্থ হয়ে যাওয়ায় গত ছয়দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে পলিথিন দিয়ে ঝুপড়ি বেঁধে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আছি। এ অবস্থায় সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে প্রতিদিন দুইবার তলিয়ে যাচ্ছে এলাকা।’ তারা বলেন, আমরা যাতে আবারো ভিটের ওপর বসতবাড়ি নির্মাণ করতে পারি সেজন্য সরকারের সহযোগিতা দরকার। তারা সাগরে বিলীন হওয়া বেড়িবাঁধ টেকসইভাবে নির্মাণেরও জোর দাবি জানান।
পেকুয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি কফিল উদ্দিন বাহাদুর বলেন, পেকুয়া সদরের একাংশ ছাড়াও তিন ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাই এ তিন ইউনিয়নকে সরকারের পক্ষ থেকে ঘূর্ণিদুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাপক পরিসরে ত্রাণ তৎপরতা চালানো ও বসতবাড়ি হারানো পরিবারগুলোকে নতুন করে পুনর্বাসনেরও দাবিও জানান তিনি।
পেকুয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ রাজু বলেন, সমুদ্র তীরের রাজাখালী, মগনামা, উজানটিয়া ও পেকুয়া সদর ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর তান্ডবে। আমি এসব ইউনিয়নের সিংহভাগ গ্রাম পরিদর্শন করেছি। এ সময় দেখেছি করুণ চিত্র। এমন কোন বাড়ি নেই যেখানে ঘূর্ণিঝড়ের ছোবল লাগেনি। গ্রামীণ অবকাঠামো, বসতবাড়ি, বেড়িবাঁধ কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। তিনি আরো বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ এসব মানুষের দুর্ভোগ স্বচক্ষে দেখলে কান্না এসে যায়। হাজার হাজার মানুষ এখন বসতবাড়ি হারিয়ে দিশেহারা। কোথায় ঘুমাবে, কী খাবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এসব মানুষ। কোথাও এক টুকরো শুকনো জায়গাও চোখে পড়েনি।
মগনামা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম, উজানটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম, রাজাখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছৈয়দ নূর ও পেকুয়া সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহ বলেন, ‘সমুদ্র তীরবর্তী এসব ইউনিয়নের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধগুলো বিলীন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় এসব ইউনিয়নে জোয়ার-ভাটা অব্যাহত থাকায় পাঁচদিন ধরে অনাহারে-অর্ধাহারে রয়েছে মানুষগুলো। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে বিলি করার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সরকারিভাবে।’ চার ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা এই মুহূর্তে বসতবাড়ি হারানো পরিবারগুলোর পুনর্বাসন ও প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা দেয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান। তারা বলেন, সবদিকে ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সামনে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
পেকুয়ার ইউএনও মারুফুর রশিদ খান বলেন, আজ(২৬মে) বিকেল পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ হিসেবে কয়েক দফায় ৪৪মেট্রিক টন জিআর চাল ও নগদ ২০হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বরাদ্দ পাওয়ার পর এসব ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে বিলি করার জন্য জনপ্রতিনিধিদের নামে ছাড় করে দেয়া হয়েছে। আগামী রবিবার থেকে ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই বসতবাড়ি হারানোদের পুনর্বাসনে যাবতীয় সহায়তা দেয়া হবে। এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত আন্তরিক। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে বৃহৎ পরিসরে ত্রাণ তৎপরতাও চালানো হবে।
চকরিয়া-পেকুয়া(কক্সবাজার-১) আসনের এমপি মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া পেকুয়া উপজেলার চার ইউনিয়ন সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। এসময় আমার সঙ্গে পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কথা হয়েছে। তিনি আমাকে আশ্বস্থ করেছেন, আগামী সপ্তাহে পুরোদমে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এজন্য ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন মন্ত্রী। এছাড়া ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াও বৃহৎ পরিসরে ত্রাণ তৎপরতা চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এজন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দও দেয়া হবে।
পাঠকের মতামত: