ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

৬৯ বছর ধরে রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার

খুটাখালী আলীমুদ্দিন ওয়াকফ্ এস্টেটের দখলে ৩০ কোটি টাকার ৫০৬একর খাসজমি

এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া :: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে খাসজমিতে একটি করে নতুন ঘর তৈরী করে দেয়ার মাধ্যমে দরিদ্র ভুমিহীন পরিবার গুলোকে মাথা গোঁজার ঠাই দেওয়া হলেও কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের মেধাকচ্ছপিয়াস্থ আলীমুদ্দীন ওয়াক্ফ এস্টেটের অবৈধ দখলে রয়েছে সরকারের ৩০কোটি টাকা মূল্যের ৫০৬ একর খাসজমি। বিগত ৬৯ বছর ধরে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র সরকারি এসব জমি নানা কায়দায় জবর দখল করে রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

২০০৭ সালে ত্বত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন যৌথ বাহিনীর সহায়তায় এসব জমি উদ্ধার করে লাল পতাকা উচিয়ে দিলেও গেল ১৪বছর যাবত উল্লেখিত জমি ফের বেদখলে রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রভাবশালী চক্রটি উল্লেখিত খাসজমি দখলে রেখে প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা লবণমাঠ ও চিংড়িজমি লাগিয়ত দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে। পক্ষান্তরে বেদখলে থাকা এসব জমি উদ্ধারে স্থানীয় প্রশাসন অদ্যবদি কার্যকর কোন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেনা বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় সচেতন মহল। এই অবস্থার কারণে সরকারি বিপুল পরিমাণ খাসজমি বেহাত হওয়ার কারনে প্রতিবছর কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক লাখ লাখ টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অবশ্য ভুমি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উল্লেখিত খাসজমি দখলে জড়িতরা ইতোপুর্বে কক্সবাজারের জজ আদালতে একটি আপীল মামলা দেয়ার কারনে রায় নিষ্পতি না হওয়ার কারণে মুলত এসব খাস জমি উদ্ধারে গতি পাচ্ছেনা স্থানীয় প্রশাসন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার খুটাখালীর মেদাকচ্ছপিয়া মৌজায় চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পুঁইছড়ি গ্রামের জাফর আলী চৌধুরীর ছেলে ইজ্জত আলী চৌধুরী’র নামীয় আরএস ৫৬ খতিয়ানের ৮৬২ একর ৬৮ শতক জমি থেকে ১৯১৯ সালে আলিমুদ্দীন ওয়াক্ফ এস্টেটের নামে ৩৩০৬ নং ভূঁয়া ওয়াক্ফ কবলা সৃজন করেন আলীমুদ্দীন চৌধুরী নামের একব্যক্তি। অথচ আর,এস খতিয়ানের রের্কডপত্রে তার কোন নাম নেই। ওই ভূঁয়া কবলা সৃজনের পর আরএস, এমআরআর ও বিএস জরীপ সম্পন্ন হলে কোন জরীপে তাদের নামে ওই জমি রেকর্ড করতে পারেনি।

১৯২৮ সালে সম্পন্ন হওয়া আর এস জরীপের পর আর এস ৫৬ খতিয়ানের জমি থেকে ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয় অর্জন ও প্রজাস্বত্ব আইনের ২০ ধারা মোতাবেক উল্লেখিত খতিয়ান থেকে ৩৭৫ বিঘার অতিরিক্ত জমি সরকারের কাছে হুকুম দখলের মাধ্যমে সারেুন্ডার করা হয়। পরে এই জমির ক্ষতিপূরণ বাবতে পুর্বের মালিক ফৌজুল করিম চৌধুরী (ক্ষতিপূরণ মামলা নং /৫৯-৬০ ইং মূলে) ওই সময় ১৭ হাজার ২৭৭ টাকা ৮০ পয়সা ও হাজী ফৌজুল কবির চৌধুরী (ক্ষতিপূরণ মামলা নং- ৩/৫৯-৬০ইং মূলে) ১৯ হাজার ৬৪০ টাকা ৩১ পয়সা সরকারের কাছ থেকে বুঝে নেন।

সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, পরবর্তীতে উল্লেখিত জমি পিআরআর জরীপে পৃথক ৬টি খতিয়ানে বিভক্ত হয়েছে। তদমধ্যে ৫৬/১ ও ৫৬/২ খতিয়ানের ৪৩১ একর ৫৬ শতক এবং ইজ্জত আলীর অধীনস্থ ১৫১ একর ৩৫ শতক জমি থেকে প্রায় ৫০৬ একর ২৬ শতক জমি সরকার খাসজমি হিসাবে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভূক্ত করেন। ৫৬/৩ খতিয়ানে বর্তমান তৎকালীন মোতায়াল্লি নজরুল ইসলাম চৌধুরী’র পিতা ফৌজুল করিম চৌধুরীর নামে ৫৭ একর ৮৯ শতক, ৫৬/৪ খতিয়ানে সুলতানুল কবির চৌধুরী, পিতা ফৌজুল কবির চৌধুরীর নামে ৩২ একর ৭৭ শতক, ৫৬/৫ ও এমআরআর ৩৫ এবং বিএস ১৫৬ খতিয়ানে আবদুল জলিল মাস্টারের নামে ৫৯ একর ২০ শতক ও ৫৬/৬, এমআরআর ৩৮ ও বিএস ৭৬ খতিয়ানে হাজী গুরা মিয়ার নামে ১২৫, একর ১১ শতক জমি রেকর্ড করা হয়। বিএস জরীপে ১১৪ ও ১১৫নং বিএস খতিয়ানে মাত্র ১৪ একর ৮০শতক জমি আলীমুদ্দীন ওয়াক্ফ এস্টেটের নামে রেকর্ড হয়েছে।

এলাকাবাসী জানায়, তৎকালীণ মোতায়াল্লি বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও তার চাচাতো ভাই বাঁশখালীর প্রয়াত আওয়ামীলীগ নেতা সুলতানুল কবির চৌধুরীর পিতা এবং ওয়াক্ফ এস্টেটের নামে সরকারী ভাবে ১০৫ একর ৪৬ শতক জমি রেকর্ডে উল্লেখ থাকলেও তারা বিগত ৬৯ বছর ধরে প্রশাসনের বিভিন্ন্ শ্রেণীর কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এবং সরকারের বিরুদ্ধে কাল্পনিক মামলা দিয়ে সরকারী খাস খতিয়ানের ৫০৬ একর জমি ভূঁয়া ওয়াক্ফ এস্টেটের নাম ভাঙ্গিয়ে জরব দখলে রেখেছে। বর্তমানে ৫০৬ একর জমির (লবণ ও চিংড়ি জমি) বাজার মূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, সরকারের বিপুল পরিমাণ খাসজমি প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় ১৯৯৫ সালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাদী হয়ে ৭৩ লাখ ৮০ হাজার ৫৬২ টাকা ও ২০০৭ সালে ১ কোটি ২৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন দখলবাজ চক্রের বিরুদ্ধে। তবে ওইসময় মোতাওয়াল্লি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও তার লোকজন এসব জমি দীর্ঘদিন ধরে ভোগ দখলে থাকার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ক্ষতি পূরণ মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে দুটি রিট পিটিশন মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে মামলা গুলো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এ অবস্থার কারনে বেহাত হতে চলা সরকারের বিপুল খাসজমি উদ্ধারে গতি পাচ্ছেনা স্থানীয় প্রশাসন।

এলাকাবাসি সুত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন যৌথ বাহিনীর সহায়তায় (তৎকালীন উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমির (সাইফুল ইসলাম) নেতৃত্বে মেধাকচ্ছপিয়াস্থ আলীমুদ্দীন ওয়াক্ফ এস্টেটে অভিযান চালিয়ে অবৈধ দখলে থাকা ৫০৬ একর খাসজমি উদ্ধার করেন। ওইসময় প্রশাসন উল্লেখিত জমিতে লাল পতাকাও উচিয়ে দেয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মোতাওয়াল্লি নজরুল ইসলাম চৌধুরী নানা কায়দায় প্রশাসনের দেয়া লাল পতাকা উপড়ে ফেলে ফের এসব জমি আবারও জবর দখল করে নেয়। সেই থেকে এখনো তাদের দখলে রয়েছে এসব জমি।

স্থানীয় এলাকাবাসি অভিযোগ তুলেছেন, সরকারি ৫০৬ একর খাসজমি জবরদখলে রাখার পাশাপাশি অভিযুক্ত প্রভাবশালী চক্রটি স্থানীয় ১১৪টি পরিবারের মালিকাধীন মেধাকচ্ছপিয়া মৌজার বিএস ৭৬ খতিয়ানের ১২৫ একর ১১ শতক চিংড়িজমি ও লবণমাঠ দখলে বিভিন্ন সময়ে হামলা ও লুটপাটে মেতেছে। তাদের অব্যাহত হামলা, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রাণি ও হুমকির কারণে বর্তমানে ভুক্তভোগী ১১৪টি পরিবারের সদস্যরা প্রতিনিয়ত তটস্থ রয়েছেন।

খুটাখালী ইউনিয়নের মেধাকচ্ছপিয়া গ্রামের লোকজন জানিয়েছেন, প্রায় ৬৯ বছর ধরে ওয়াক্ফ এস্টেটের নাম ভাঙ্গিয়ে প্রভাবশালী চক্রটি সরকারের বিপুল পরিমাণ খাসজমি এভাবে অবৈধদখলে রাখলেও ইতিপূর্বে প্রশাসন এসব জমি উদ্ধারে কোন প্রদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো অতীতে প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা সুবিধা নিয়ে গোপনে দখলবাজদেরকে নানাভাবে সহায়তা দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই অবস্থার সুযোগে সংশ্লিষ্টরা বছরের পর বছর এসব জমি দখলে রেখে চলছে।

এভাবে তারা বিগত ৬৯বছর ধরে এসব জমি দখলে রেখে লবণ ও চিংড়ি চাষাবাদ করে প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অপরদিকে বিপুল পরিমাণ খাসজমি বেদখলে থাকায় সরকারও প্রতিবছর লাখ লাখ টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এলাকাবাসি দখলবাজ চক্রের কবল থেকে সরকারি এসব খাসজমি উদ্ধারপুর্বক চলমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় সেখানে ভুমিহীনদের জন্য নতুন ঘর নির্মাণে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহনে প্রশাসনের নজরদারি কামনা করেছেন।

সরকারের বিপুল পরিমাণ খাসজমি দখলমুক্ত করতে প্রশাসনের ভূমিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো.তানভীর হোসেন বলেন, উপজেলার খুটাখালীতে এতপরিমাণ সরকারি খাসজমি বেদখলে থাকার বিষয়টি অবশ্যই যাছাই করা হবে। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সরকারি এসব খাসজমি উদ্ধারে প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া হবে। #

 

পাঠকের মতামত: