ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

প্রসঙ্গ: জন্ম নিবন্ধন সনদ

কক্সবাজারবাসী ভাসছে সমুদ্রের নোনা জলে, রোহিঙ্গারা ভাসানচরে 

এম.আর মাহমুদ ::

আল্লাহর অশেষ কৃপায় আরও একটি নতুন বছরে পদার্পণের সৌভাগ্য হয়েছে। করোনা মহামারীর কারণে ২০২০ সাল ছিল মানবজাতির জন্য অভিশপ্ত একটি বছর। অবশ্যই এখনও করোনা মহামারী চলমান রয়েছে প্রতিদিনই দেশে অনেক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে এবং করোনা আক্রান্ত হচ্ছে। আবার বেশিরভাগ মানুষ মহান সৃষ্টিকর্তার দয়ায় সুস্থ্যতা লাভ করছে। ২০২০ ও চলতি ইংরেজী নববর্ষের শুরুতে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে। ২০২০ সালের মার্চের মাঝামাঝি থেকে করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ায় লকডাউনের কারণে দেশের অর্থনৈতিক গতি অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছিল। পরে করোনা মহামারী একটু সহনীয় পর্যায় নেমে আসার পর লকডাউন প্রত্যাহার করেছে সরকার। ফলে মানুষ অনেকটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে সক্ষম হয়েছে। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ার পর এখনও খোলার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সরকার করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনিচ্ছা সত্বেও বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ক্ষেত্রে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কবে জানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরোদমে সচল হয়। আসল কথা হচ্ছে চলতি বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভর্তির ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে নতুন জটিলতা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক শিক্ষার্থীদের অনলাইন জন্ম নিবন্ধন ছাড়া ভর্তি করছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে অভিভাবকেরা ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য সেবাকেন্দ্রে গিয়ে ভিড় জমাচ্ছে। মূলতঃ রোহিঙ্গা আগমনের কারণে কক্সবাজার জেলার ৮টি উপজেলা ৪টি পৌরসভা সহ ৭১টি ইউনিয়ন পরিষদের জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় সৃষ্টি হয়েছে মহা জট। এ জট খুলে দিলেও নানা জটিলতার কারণে জন্ম নিবন্ধন বঞ্চিত শিশুরা সহজভাবে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পাচ্ছে না। মানবিক কারণে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে তিলে তিলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে এ জেলার প্রকৃত বাসিন্দারা। কক্সবাজার জেলায় জন্ম নিয়ে আমরা যেন অপরাধ করেছি। আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের একটি অংশ স্বেচ্ছায় ভাসানচরে আশ্রয় পাচ্ছে। হয়তো যেসব রোহিঙ্গা ভাসানচরে যাবে তাদের আশ্রয় সেখানেই হবে। কিন্তু তাদের কারণে জেলার বাসিন্দারা নিজ ভূবনে ভাসছে যা বলাও যাচ্ছে না, হজমও করা যাচ্ছে না। জন্ম নিবন্ধন বঞ্চিতদের জন্ম নিবন্ধন করতে যেসব শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে তা পূরণ করা কতই যে কষ্টকর ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে বর্ণনা করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক সরবরাহকৃত জন্ম নিবন্ধনের শর্তগুলো হচ্ছে মা-বাবার জন্ম নিবন্ধন, জাতীয়তা সনদ, টিকার কার্ড, চৌকিদারের নাম, সীলসহ স্বাক্ষর, ওয়ার্ড মেম্বার ও মহিলা মেম্বারের সীলসহ স্বাক্ষর, সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সীলসহ স্বাক্ষর, চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর, ইউপি সচিবের স্বাক্ষর, বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে মেডিকেল অফিসারের স্বাক্ষর, চৌকিদারী টেক্স আদায়ের ফটোকপি সংযুক্ত করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে পাঠানোর পর যাচাই বাছাই করে ইউনিয়ন পরিষদে প্রেরণ করবে। এরপরে সব শর্ত পূরণ হলে হয়তো জন্ম নিবন্ধন হবে। তবে কথা হচ্ছে আগে ইউনিয়ন পরিষদ জন্ম নিবন্ধন করতে গিয়ে অনেকেই জাতীয় সার্ভারভূক্ত হতে পারেনি। এর জন্য দায়ী কে? তার কোন সঠিক জবাব নেই। তবে যারা সার্ভারভূক্ত হয়নি তারা অনলাইন ভেরিফাই কপি পাচ্ছে না। এ ধরণের ভুক্তভোগীরা কি করবে তার কোন সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে না। জেলার সব’কটি উপজেলায় এ সমস্যায় ভুগছে বেশুমার পাবলিক। অপরদিকে জন্ম নিবন্ধনের নাম্বার দিতে ব্যর্থ হয়ে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত উপবৃত্তির টাকা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কক্সবাজার জেলার কৃতি সন্তান হেলাল উদ্দিন সাহেব বিষয়টি সদয় দৃষ্টিতে দেখলে কক্সবাজারের প্রকৃত বাসিন্দারা উপকৃত হবে বলে জেলাবাসীর অভিমত। চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের সচিব নুরুল কবির জানিয়েছেন, এ ইউনিয়নের বেশক’জন পরিষদ সদস্যের জন্ম নিবন্ধন সনদ নেই। সার্ভারে তাদের জন্ম নিবন্ধন সনদ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তারা নতুন জন্ম নিবন্ধন হতে যাওয়া শিশুদের জন্ম নিবন্ধন ফরমে পরিষদ সদস্য হিসেবে স্বাক্ষরও করতে পারছে না। বেরসিক এক ব্যক্তি মন্তব্য করতে শোনা গেছে, কক্সবাজার জেলার জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম দেখে তার মতে ‘নিজে কানা পথ দেখে না, আরেক কানাকে পথ দেখায়’। ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক এক সচিব ছুরত আলম জানিয়েছেন, ২০০৭-২০০৮ সালে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে বিভিন্ন এনজিও সংস্থাকে দিয়েছিল এ দায়িত্ব। তারা নামমাত্র অর্থে কিছু সংখ্যক স্বল্প-শিক্ষিত কর্মীদের দিয়ে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে গিয়ে এ সর্বনাশ করেছে। যার মাশুল এখন গুনতে হচ্ছে কক্সবাজার জেলার বাসিন্দাদের। জন্ম নিবন্ধনের ভুলও সংশোধন করা যাচ্ছে না। লেখাটি শেষ করতে গিয়ে একটি গল্পের অবতারণা না করলে হয় না ‘এক ব্রা‏হ্মণ বাজার থেকে একটি পাঠা ক্রয় করে মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছিল মন্দিরে। ব্রা‏হ্মণ বাবুর উদ্দেশ্য ছিল পাঠাটি বলি দিয়ে পুরো এলাকাকে পবিত্র করবে। কিন্তু বিধিবাম ৩ বাটপার জুটলো তার পিছনে। তারা ফন্দি করলো ব্রা‏‏‏‏হ্মণ বাবুর কাছ থেকে পাঠাটি নিয়ে ভুরিভোজ করবে। কৌশল করলেন ৩ বাটপার ব্রা‏হ্মণ বাবু হেঁটে যাওয়ার রাস্তার ৩ মোড়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রথম বাটপার ব্রা‏হ্মণ বাবুকে কুর্নিশ করে বিনয়ের সাথে বললেন, ব্রা‏‏হ্মণ বাবু একি করলেন? কুকুরের বাচ্চা একটি মাথায় নিয়ে যাচ্ছেন কই? তখন ব্রা‏‏হ্মণ বাবু ওই বাটপারকে ধমক দিয়ে চলে গেলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর দ্বিতীয় বাটপার ব্রা‏‏হ্মণ বাবুর কাছে গিয়ে বিনয়ের সাথে প্রণাম করে একই কথাই বললেন। তখন ব্রা‏‏হ্মণ বাবু একটু চি‎ি‎ন্তত হলেন। তারপরও ব্রা‏‏হ্মণ বাবু হাঁটতে লাগলেন। তৃতীয় বাটপার ব্রা‏‏হ্মণ বাবুর পা ধরে কুর্নিশ করে বললেন হায় হায় ব্রা‏‏হ্মণ বাবু একি করলেন? আপনি কুকুরের বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? বিষয়টি আমি সবাইকে জানিয়ে দেব। আপনার এ অবস্থা জানলে আর কোন লোক মন্দিরে গিয়ে পুঁজা দেবে না। তখন ব্রা‏হ্মণ বাবু চিন্তা করলেন, ৩ ব্যক্তি একই কথা বলার পিছনে কোন রহস্য রয়েছে। হয়তো আমার কেনা পাঠাটি কুকুরের বাচ্চা হতে পারে। তখন ব্রা‏হ্মণ বাবু মাথা থেকে পাঠাটি ফেলে দিয়ে গঙ্গায় স্নান করে পুতপবিত্র হয়ে চলে গেলেন। পরে ৩ বাটপার পাঠাটি নিয়ে ভুরিভোজ সারলেন। আর ব্রা‏হ্মণ মনকে প্রভূত দিল অন্তত সমাজের লোকজন মন্দিরে গিয়ে পুঁজাতো দেবে। এভাবেই তিনি বাটপারদের হাতে পাঠাটি দিয়ে পবিত্র হলেন। এ গল্পটি অবতারণার পেছনে রয়েছে বিশাল ব্যাখ্যা। শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষই জন্ম নিবন্ধনের ভোগান্তির কারণে জাতীয় পরিচয়ও পাবে না। বিষয়টি সদয় বিবেচনার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

 লেখক:  এম.আর মাহমুদ, সভাপতি-চকরিয়া প্রেসক্লাব, চকরিয়া, কক্সবাজার।

পাঠকের মতামত: