পাসপোর্ট নিতে গিয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশন। বিষয়টি প্রায় আলোচনায় আসে, বিশেষ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ঘুষ, দুর্নীতি বিষয়ক জরিপ যখন প্রকাশ হয়। এতে দেখা যায়, পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে সবচেয়ে বেশি হয় ঘুষ বাণিজ্য। এটি বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা, গোলটেবিল বৈঠক হলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সেটি আর এগোয় না।
একজন মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকার পরও কেন তাকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। প্রশ্ন উঠতে পারে, ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রেরতো অভাব নেই। তাহলে উত্তরও এই যে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে যেটি হয়ে থাকে সেটি পুরোটাই ভুয়া।
একজন মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকার পরও কেন তাকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। প্রশ্ন উঠতে পারে, ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রেরতো অভাব নেই। তাহলে উত্তরও এই যে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে যেটি হয়ে থাকে সেটি পুরোটাই ভুয়া।
আমাদের দেশের সচেতন প্রায় প্রতিটি নাগরিকের অভিজ্ঞতা রয়েছে পাসপোর্ট করার। সেটি একজন নাগরিক হিসেবে তার অধিকারও। কিন্তু আমাদের দেশে যা হয় জটিল জীবনে যতোসব জটিল নিয়মের ফাঁকে জীবনকে আরো বিষময় করে নীতিগুলো। পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রেও তাই। ঢাকা পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি কিছুটা কমলেও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের অবস্থা যাচ্ছেতাই।
স্বজনদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসে দালাল ছাড়া পাসপোর্ট পাওয়াই দুরূহ। নির্ধারিত ফি এর চেয়ে বেশি ফি দিয়ে দালাল ধরে তবেই মিলবে পাসপোর্ট। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। আর সারাদেশে পাসপোর্ট করানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভোগান্তির এবং ফাঁসানোর নাম পুলিশ ভেরিফিকেশন। নিজে সাংবাদিক হওয়ার পরও এই ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। পরিচয় পাওয়ার পর পুলিশ বাড়িতে গিয়ে বলেছে, ‘এতোদূর থানা থেকে এসেছি চা-পানি খাবো না!’ এই আবদারে কি না করা যায়!
ইচ্ছে হলেই প্রশ্রয় না দেয়া যেতো, এতে পুলিশ রিপোর্ট পেতে দেরি হতো। নয়তো উল্টাপাল্টা কিছু লিখে দিতো। পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি বা হয়রানির চেয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশনের হয়রানি পাসপোর্ট গ্রাহকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন হয়রানির উদাহরণ সারাদেশে ভূরি ভূরি। এসব ক্ষেত্রে যারা দেশের বাইরে থাকে জরুরি প্রয়োজনে তাদেরকে আরো বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়।
এ নিয়ে টিআইবি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বেশ আলোচনায় আসে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে নতুন পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতির কারণে সেবাগ্রহিতাদের হয়রানি ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা ওই ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করে দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ(টিআইবি)।
সংস্থাটি বলছে, নতুন পাসপোর্টের আবেদনকারীদের তিন চতুর্থাংশকেই পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় অনিয়ম ও হয়রানির শিকার হয়ে ‘ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত টাকা’ দিতে হয়। হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পাসপোর্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নিয়ম বাতিলের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। কিন্তু মুশকিল হলো পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা এর সাথে একমত হলেও পুলিশের একটি অংশ চায় না এটি বাতিল হোক।
আলোচনার আগে দেখা যাক, টিআইবির ওই গবেষণা প্রতিবেদনটিতে কী বলা হয়েছে, গবেষণা প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে পুলিশ ভেরিফিকেশনে হয়রানি হচ্ছে কাজেই এটার কোনো দরকারই নেই। এর বদলে সকল নাগরিকের জন্য ‘বায়োমেট্রিক ডাটা ব্যাংক’ এবং ‘অপরাধী তথ্য ভাণ্ডার’ তৈরি করে তার সঙ্গে পাসপোর্ট অফিস ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের সংযোগ স্থাপন করার সুপারিশ করা হয়।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ পাসপোর্ট সংশ্লিষ্ট কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। এর মধ্যে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে বাধ্য হওয়ার কথা জানিয়েছেন। আর ২৭ শতাংশ উত্তারদাতা অযথা সময়ক্ষেপণের শিকার হওয়ার এবং ২ দশমিক ২ শতাংশ পাসপোর্টগ্রহীতা সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার কথা বলেছেন।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও অনিয়ম হয় পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে। ৭৬ দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা এ কাজের জন্য অনিয়ম ও হয়ারনির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। ৭৫ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য তাদের ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত টাকা দিতে হয়েছে। ঘুষের গড় পারিমাণ ৭৯৭ টাকা। আর পাসপোর্ট অফিসে ঘুষের গড় পরিমাণ দুই হাজার ২২১ টাকা।
তবে টিআইবির তথ্য অনুযায়ী পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতি আগের তুলনায় কমেছে। ২০১৫ সালে টিআইবির জাতীয় খানা জরিপে ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশ উত্তরদাতা পাসপোর্ট করাতে গিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা বলেছিলেন। এছাড়া পাসপোর্ট অফিসের আবেদনপত্রে সত্যায়ন ও প্রত্যয়নের বিধানও বাতিল করার সুপারিশ করেছে টিআইবি।
প্রকৃতপক্ষে কী হয় পুলিশ ভেরিফিকেশনে। সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয় পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি), তাদের ছাড়পত্রের (ভেরিফিকেশন) জন্য। পুলিশের এই দপ্তর ‘অযথা’ আবেদনপত্রে ত্রুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। জঙ্গি কার্যক্রম বা অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার সন্দেহের কথা বলে ভয় দেখায়। বাড়িতে না গিয়ে চায়ের দোকান বা থানায় ডেকে পাঠায়। ঘুষ দাবি করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা বিকাশ বা রকেটের মাধ্যমেও পাঠাতে বলে।
ইতিহাস বলছে, ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসছে এই ভেরিফিকেশনের বিষয়টি। আগে কোনো কাজে পুলিশের কাছে থেকে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট লাগতো। সেখানে লেখা থাকতো- ‘ওই ব্যক্তি কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত নয়’। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, এলাকার দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান বা মেম্বার সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষস্থানীয় ও স্বনামধন্য অনেকেকে সার্টিফাইড করছে, ‘লোকটা ভালো, আপনি পাসপোর্ট বা চাকরি বা বিদেশ যাওয়ার সুযোগ দিতে পারেন।’ কী হাস্যকর!
আমরা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলছি। এখন এই গণতান্ত্রিক সময়েও জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের অবিশ্বাস কিন্তু কমেনি। যারা জনগণের প্রতিনিধি বলে নিজেদের দাবি করেন, তারা জনগণকে বিশ্বাস করেন না। নইলে সবাই কেনো বলবেন, ‘পুলিশ ঠিক হয়ে গেলে সব ঠিক।’ পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানোটাই যেন চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীর সভ্য দেশ বা নিজের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অন্যান্য দেশে বিপদের সময় পুলিশ পাশে এসে দাঁড়ালে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আর আমাদের দেশের মানুষ মনে করেন ‘না জানি কোন ঝামেলায় পড়ি।’
পাসপোর্ট এর ক্ষেত্রে দালালের কাছে কেন যায় মানুষ। এর কারণ ভোগান্তি ও ঝামেলা এড়ানো, নিয়ম না জানা, সময়ের আগে পাসপোর্ট পাওয়ার আগ্রহ, পুলিশি হয়রানি এড়ানো এবং সময়ের অভাব। টিআইবি রিপোর্ট বলছে, সিলেটে বিভাগের পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতারা দালালের কাছে বেশি যান। আর সবচেয়ে কম যান রাজশাহী বিভাগের সেবা গ্রহীতারা। সিলেটের ৭০ ভাগ মানুষ পাসপোর্টের জন্য দালালের শরণাপন্ন হয়, আর রাজশাহীর হয় ২০ ভাগ মানুষ।
সিলেটের মানুষের আগে থেকেই বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। বিশেষ করে লন্ডনে। সে কারণে হয়তো তারা দালালদের শরণাপন্নও বেশি হয়। কিন্তু দালালদের একার পক্ষেতো এসব কাজ করা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে এসবি পুলিশ ও পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ। দালালরা পাসপোর্ট প্রার্থীদের কাছ থেকে যে অর্থ নেয়, তার একটি অংশ এসবি পুলিশ ও পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেয়।
আর দালালরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থাকে বলে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পান না আবার কেউ করলেও তাকে হেনস্তার স্বীকার হতে হয়। তাই শুধু দালালদের ধরলে হবে না সাথে সাথে অসাধু কর্মচারীদের চিহ্নিত করে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
টিআইবির এই রিপোর্টের পর পাসপোর্ট অফিসের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে তিনি টিআইবির বেশ কিছু বিষয়ে আপত্তি তুললেও পুলিশ ভেরিফিকেশন এখনো দরকার বলে মত দেন। অনেক রোহিঙ্গা ও ভারতীয় কিছু নাগরিক পাসপোর্ট করতে এসেছে, যা ধরা পড়েছে বলেও জানান তিনি। সবার স্মার্ট আইডি কার্ড হয়ে গেলে তখন এটি বিবেচনা করা হতে পারে বলে জানান তিনি।
পাসপোর্ট সপ্তাহ উদ্বোধনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, পাসপোর্ট সেবায় জনগণের হয়রানি বন্ধে এখন থেকে অনলাইনে পুলিশ ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভীর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন বিষয়ক যে বৈঠক হয় সেখানে সিদ্ধান্ত হয় সামনে থেকে দেশের জনগণের পাসপোর্ট আবেদনের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যবস্থার আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত এখনো আলোর মুখ দেখেনি। বৈঠকের অধিকাংশ কর্মকর্তা পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা তুলে নেয়ার পক্ষে মত দেন।
প্রকৃতপক্ষে আমার মনে হয়, যে নাগরিকের জাতীয় নাগরিকত্ব সনদ রয়েছে সেই নাগরিকের পাসপোর্ট পাওয়ারও অধিকার রয়েছে। যদিও পুলিশের একটি খোঁড়া অজুহাত থাকে, ভেরিফিকেশন না থাকলে খারাপ লোকেরা পাসপোর্ট পেয়ে যাবে। আমার প্রশ্ন এখনওতো অনেক খারাপ লোক পাসপোর্ট পাচ্ছে। নইলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ গিয়ে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি করছে কেমন করে।
পুলিশ ভেরিফিকেশনে এলে টাকা দিলেই যদি সমস্যার সমাধান হয়ে যায় তবে খারাপ লোকেরতো ওই সামান্য টাকা দিতে সমস্যা থাকার কথা নয়। পাসপোর্টতো কোনো নাগরিকের সার্টিফিকেট নয়। একজন মানুষ অপরাধী কিনা বা কোনো সামাজিক অপরাধের সাথে জড়িত কিনা সেটাতো পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনা হতে পারে না। তাহলে তাকে কেনো জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হলো। সে সময়ইতো তাকে আটকানোর কথা। নাকি বিষয়টা এমন দেশে থেকে অপরাধ করো, জাতীয় পরিচয়পত্র পাও। কিন্তু পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে কোনো চাকরি করতে পারবে না।
লোকটি অপরাধী বা দেশের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে তার পাসপোর্ট আটক করার উদাহরণতো অনেক রয়েছেই। অনেক রাজনৈতিক নেতারও পাসপোর্ট আটক করা হয়েছে নিকট অতীতে। এর মধ্যেও যে ভালো উদাহরণ নেই তা নয়। অনেক পুলিশ পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনে গিয়ে গোলাপ ফুল উপহার দিয়েছেন তেমন ছবিও আমরা সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি। তবে সবচেয়ে বেশি যেটি জরুরি পুলিশ ভেরিফিকেশনটা বন্ধ করা। এটি কার্যত একটি সেকেলে পদ্ধতি। যা জনগণকে হয়রানি করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি বন্ধ করা গেলে পাসপোর্ট অফিসের ভোগান্তি কমবে অনেকটাই।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
পাঠকের মতামত: