ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

রামুর মেয়ে রোমেনার আকাশ ছোঁয়ার গল্প

॥ সোয়েব সাঈদ ॥

কক্সবাজারের রামু উপজেলার অতিদূর্গম এলাকা ঈদগড় ইউনিয়নের খোন্দকারপাড়া গ্রামের মেয়ে রোমেনা হোছাইন। ১৯৯৫ সালে মাত্র ৪ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর সংসারে দেখা দেয় আর্থিক অনটন। পরবর্তীতে জীবন-যাপন যেমন কঠিন হয়ে পড়ে তেমনি উপক্রম হয়েছিলো লেখাপড়াও বন্ধের। নিজের অদম্য ইচ্ছা শক্তি আর মায়ের উৎসাহে সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ছিনিয়ে এনেছে জীবনের স্বর্ণালী অধ্যায়। পড়াশোনায় একের পর এক সফলতার গন্ডি পেরিয়ে রোমেনা হোছাইন বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারেও উত্তীর্ণ হয়েছেন। বর্তমানে এফসিপিএস (ফাইনাল পার্ট) এবং এমডি (নেফ্রোলজি) অধ্যয়নরত আছেন।

রূপকথার মতই যেন রোমেনা হোছাইনের পথ চলা। শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে ডা. রোমেনা হোছাইন চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে “জয়িতা ২০১৭” পুরস্কার পেয়েছেন। এরআগে তিনি কক্সবাজার জেলা এবং রামু উপজেলা পর্যায়েও শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে “জয়িতা-২০১৭” হিসেবে সম্মাননা পেয়েছিলেন। ডা. রোমেনা হোছাইন অর্জন বিসিএস (স্বাস্থ্য), এফসিপিএস (ফাইনাল পার্ট) এবং এমডি (নেফ্রোলজি) অধ্যয়নরত রয়েছেন। যা একজন চিকিৎসকের জন্য অনেক বড় অর্জন। জানা গেছে, আগামী ৩ সেপ্টেম্বর ডা. রোমেনা হোছাইন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় সহকারী সার্জন হিসেবে চাকরিতে যোগদান করবেন।

ডা. রোমেনা হোছাইনের পিতার নাম মরহুম তোফাজ্জল হোসেন, মায়ের নাম রুকুম রাবিয়া। তিন ভাই বোন এর মধ্যে সে ছোট। সে রামুর ঈদগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে বৃত্তি সহ কৃতিত্বের সাথে ৫ম শ্রেণি পাশ করে সর্বোচ্চ নাম্বার নিয়ে (স্কুল ফাস্ট), ২০০২সালে ৬ষ্ট শ্রেণিতে ভর্তি হয় ঈদগাহ জাহানারা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানেও ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুল ফাস্ট ছিলো। ২০০৫ সালে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হয় কিশলয় আদর্শ শিক্ষা নিকেতনে এবং ২০০৬ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে গোল্ডেন জিপিএ-৫ অর্জন করে। পের চট্টগ্রাম কলেজে থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ অর্জন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। তিনি ৩৬ তম বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ প্রাপ্ত হন। এছাড়াও তিনি ঢাকা বারডেমে ডায়াবেটিস রোগ নিরাময়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

ডা. রোমেনা হোছাইনের বড় ভাই রেজাউল করিম রাজু রামু ঈদগড় বড়বিল কমিউনিটি ক্লিনিকে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, ছোট বোন রোমেনার জীবনে সবসময় সঙ্গী ছিলো বই আর বই, সাথে পড়া আর পড়া। পড়ালেখার প্রতি জেদটা ছিলো অনন্য। পড়ার সময় তার আশপাশে কেউ কথা বলতে পারতো না। এমনকি রান্নাঘরে ডেক্সি, বাসন-কোসনের শব্দ হয় এমন ভাবে নাড়া যেত না। সর্বোপরি তার মনোযোগ নষ্ট হয় এমন কোন কাজ করা যেত না।

রেজাউল করিম আরো জানান, ১৯৯৫ সালে রোমেনা হোছাইন প্রথম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় বাবা মারা যান। পিতার মৃত্যুর পরিবারে আর্থিক দৈন্যতা দেখা দেয়। ওই সময় দাদা বাড়ির লোকজন বাবার প্রাপ্য সম্পদ তাদের না দেয়ায় তারা আরো বিপাকে পড়েন। ওই সময় পাশর্^বর্তী কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামাবাদের পশ্চিম গজালিয়ার এলাকার বাসিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল মোতালেব তাদের পরিবারকে বিভিন্নভাবে সহায়তা ও প্রেরনা দিয়ে পড়ালেখায় উৎসাহী করেন। দাদার বাড়ির কারো সহায়তা না পেলেও ওই সময় নানা-নানী, মামা-খালারা তাদের পাশে যে কোন প্রয়োজনে সহায়তার হাতি বাড়িতে দিতেন। তাদের অবদানেই আজ তাঁর পরিবারের সবাই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

রোমেনা হোছাইনের বড় বোন নিলুফা ইয়াছমিন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাশ করার পর চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির ফরম নিয়েও ভর্তি হননি। ওই সময় তিনি ভেবেছিলেন, নানার পরিবার তাঁর পরিবারকে অনেক কিছুই দিয়েছেন। তাই এবার নিজেকেও কিছু করতে হবে। এ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনিও যোগ দেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায়। তবে চাকরি করেও পড়ালেখা চালিয়ে যান নিলুফা ইয়াছমিন। তিনি কক্সবাজার সরকারি কলেজ থেকে বাংলায় এমএ পাশ করেছেন। চাকরির অর্থ দিয়ে তিনি ছোট বোন রোমেনার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন।

বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারি সার্জন ডা. রোমেনা হোছাইন জানিয়েছেন, নিজের ইচ্ছে শক্তি আর পরিবারের সদস্যদের অনুপ্রেরনায় তাঁর এ সফলতা। ভবিষ্যতে একজন দক্ষ কিডনী স্পেশালিষ্ট হয়ে জনকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চান। এজন্য তিনি সকলের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেছেন।

রামু উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শিরিন ইসলাম জানিয়েছেন, চেষ্টা করলে প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরাও শিক্ষা অর্জন করে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসতে পারে। রামুর মেয়ে ডা. রোমেনা হোছাইন এর অনন্য দৃষ্টান্ত। বর্তমান সরকার তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীদের “জয়িতা” চিহ্নিত করে স্বীকৃতি প্রদান করছে। এরই আওতায় ২০১৭ সালে “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” কার্যক্রমে ডা. রোমেনা হোছাইন রামু উপজেলা, কক্সবাজার জেলা এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অজর্নকারী নারী হিসেবে “জয়িতা ২০১৭” পুরস্কার পেয়েছেন।

রামুর ঈদগড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ ভূট্টো জানিয়েছেন, ডা. রোমেনা হোছাইন এ ইউনিয়নের একমাত্র নারী, যিনি শিক্ষা এবং চাকুরী ক্ষেত্রে এ ধরনের বিরল সফলতা অর্জন করেছেন। তাঁর এ সাফল্যে এলাকাবাসী যেমন আনন্দিত তেমনি ইউনিয়নের সব নারীরা এ সফলতাকে অনুকরণীয় মনে করে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরনা পাবে।

ডা. রোমেনা হোছাইনের মা সফল জননী রুকুম রাবিয়া জানান, কেবল মেয়ে রোমেনা নয়, তার তিন ছেলে-মেয়েই বর্তমানে সরকারি চাকুরীরত আছে। এরমধ্যে বড় মেয়ে নিলুফা ইয়াসমিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, একমাত্র ছেলে রেজাউল করিম রামু উপজেলার ঈদগড় বড়বিল কমিউনিটি ক্লিনিকে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি আরো জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর এক ভাই সহায় সম্পত্তি জবর-দখল করে নেয়। যথাসময়ে সে সম্পদ পেলে তাদের আর্থিক সংকটে পড়তে হতো না। এরপরও মৃত্যুপথযাত্রী স্বামীর কথা স্বরণ করে তিনি সন্তানদের লেখাপড়া চালানোর প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যান। যার সুফল এখন পুরো পরিবার পেয়েছে।

॥ নারীর সফল পথচলায় প্রেরনার উৎস জয়িতা অন্বেষণ ॥

ডা. রোমেনা হোছাইনের মতই সমাজে তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীদের “জয়িতা” চিহ্নিত করে স্বীকৃতি প্রদান করা হচ্ছে। “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” কার্যক্রমের আওতায় রামু উপজেলার ৫টি ক্যাটাগরিতে জয়িতা নির্বাচনের জন্য সকল ইউনিয়ন পরিষদে মূল্যায়ন ছক ও নির্দেশিকা পাঠানো হয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রাপ্ত আবেদন যাচাই-বাছাই করে ৫ জনকে চূড়ান্তভাবে মনোনীত করা হয়। এরা হলেন, অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী প্রতিতা বড়–য়া, শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অজর্নকারী ডা. রোমেনা হোছাইন, সফল জননী নারী রুকুম রাবিয়া, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যেমে জীবন শুরু করে সফল নারী যুতি ধর এবং সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য নিরদা বড়–য়া।

এছাড়া ২০১৬ সালে “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” কার্যক্রমের আওতায় রামু উপজেলার ৫টি ক্যাটাগরিতে জয়িতা নির্বাচন করা হয়, এরা হলেন, অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী হাছিনা আকতার, শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অজর্নকারী টুম্পা রানী শীল, সফল জননী নারী মালঞ্চ বড়–য়া, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যেমে জীবন শুরু করে সফল নারী ফাতেমা বেগম এবং সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য লায়লা বেগম।

 

পাঠকের মতামত: