কক্সবাজারের রামুতে কর্মরত সিএইচসিপি নুরুল আমিন ও পিংকী শর্মা জানান- একজন সিএইচসিপি ৪০/৫০ জন শিশু,কিশোর, প্রাপ্ত বয়স্ক নারী- পুরুষ সহ গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টি সেবা ও সাধারণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা দিচ্ছেন। সাধারণ সমস্যা যেমন সাধারণ সর্দি, জ্বর,কাশি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, এ্যালার্জি ও শ্বাসকষ্টের রোগীরা এখন জীবন বাঁচাতে ভিড় করছেন গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকে। এনসিডি রোগের স্বাস্থ্য শিক্ষা দেওয়া হয় ক্লিনিকে। সাথে ব্লাড প্রেসার ও ডায়াবেটিস চেক করে দেন সিএইচসিপি। প্রয়োজনে উচ্চতর হাসপাতালে রেফার করেন। যার ফলে গ্রামীণ জনপদের মানুষ হাতের নাগালে পাচ্ছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা। সেবা পেয়ে সন্তুষ্ট কোটি কোটি মানুষ। কিন্ত গত জুলাই থেকে অধ্যাবধি তাদের মতো বেতনহীন নিয়মিত সেবা দিচ্ছে সিএইচসিপিগণ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে এই কমিউনিটি ক্লিনিক। গেল সরকারের খামখেয়ালিপনা, একগুঁয়েমি ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন সিএইচসিপি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে পরিবার নিয়ে শঙ্কায় দিন পার করছেন তারা।
তারা আরও জানিয়েছেন, ক্লিনিকে সেবা প্রদানের জন্য তিনজন কর্মীর মধ্যে রাজস্ব খাতে নিয়োগপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী সপ্তাহে ২ দিন ক্লিনিকে সেবা দেন। আর যিনি ক্লিনিকের ইনচার্জ বা নিয়মিত ৬ দিন ক্লিনিকের যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও ক্লিনিক প্রধান হিসেবে কর্মরত তিনি প্রকল্প না ট্রাস্ট, তা গেল ১৩ বছরেও নির্ধারণ হয়নি। রাজস্বের স্বপ্ন দেখিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে দীর্ঘ এক যুগ। একই প্রতিষ্ঠানে ২জন রাজস্বের কর্মী কিন্তু যিনি প্রতিষ্ঠান প্রধান তিনি প্রকল্প না ট্রাস্ট তার কিছুই জানে না সংশ্লিষ্ট কর্মী।একই প্রতিষ্ঠানে সকল কর্মীদের চাকরি একই সিস্টেমে নিয়োগের উপর জোর দেন। কেউ রাজস্বের,কেউ প্রকল্প বা ট্রাস্টের হলে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয় বলে জানান সিএইচসিপিগণ। এমন বৈষম্য মূলক কর্মী নিয়োগে ফুঁসে উঠছে চৌদ্দ হাজার সিএইচসিপি।
একই প্রতিষ্ঠানে কেউ রাজস্ব আবার কেউ প্রকল্প বা ট্রাস্টের! এমন বৈষম্য স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে মানতে নারাজ সিএইচসিপি’রা। তারা অনতিবিলম্বে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের দাবি জানান। তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা চাকরী রাজস্ব খাতে স্থানান্তর সহ বকেয়া ইনক্রিমেন্ট সহ সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা চান। কেননা, একই বেতনে চাকরি করছেন দীর্ঘ ১৩ বছর, নেই কোনো ইনক্রিমেন্ট। পাচ্ছেন না ওপির সুবিধাও।
প্রাপ্ত তথ্যমতে- চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির (এইচপিএনএসডিপি) (২০১৭-২০২২) অধীন অপারেশনাল প্ল্যানে (ওপিতে) সিএইচসিপিদের ইনক্রিমেন্ট ও ধাপে ধাপে রাজস্ব খাতে চাকরি স্থানান্তরের নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি কোনো কিছুর বাস্তবায়ন হয়নি। বারবার আশ্বাসেই থেমে আছে সিএইচসিপিদের জীবন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে সিএইচসিপিদের চাকরি স্থায়ীকরণের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা চিঠির মাধ্যমে সিভিল সার্জনদের জানান তৎকালীন পরিচালক প্রশাসন ডা. মো. শাহনেওয়াজ। আবার ২২ এপ্রিল ২০১৪ সালে তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব ডা. মাখদুমা নার্গিস চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের নিমিত্তে সিএইচসিপিদের সার্ভিস বুক খোলা ও বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন পাঠানোর কথা বলে চিঠি পাঠান সিভিল সার্জনদের কাছে। ফলে সিএইচসিপিরা চাকরি রাজস্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
১৩ বছরে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প অফিস স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্বকরণের বিষয়ের আলোকে কয়েক দফা চিঠি চালাচালি করে। এরই অংশ হিসেবে গত ১৬ জুন ২০১৩ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়ন ৩ অধিশাখা, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা স্মারক নং- ৪৫.১৭৪.০১৫.০১০০.০০১.২০১১-২১৬ এ রিভাইটালাইজেসন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ (আরসিএইচসিআইবি) শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) রাজস্ব খাতে স্থানান্তর সম্পর্কিত প্রস্তাব প্রেরণ করে।
গত ২০১৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহাখালী ঢাকা, স্মারক নং স্বা:অধি:/প্রশা-৩/বিবিধ-৩/
এর ধারাবাহিকতায় গত ১৯/০৬/২০১৪ স্মারক নং- আরসিএইচসিআইবি/কন:/শৃঙ্খলা-৯৭/
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে জুলাই ২০১১ থেকে আরসিএইচসিআইবি প্রকল্পের পাশাপাশি ৩য় স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচি (এইচপিএনএসডিপি)-এর কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) অপারেশনাল প্ল্যানের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে যা ডিসেম্বর ২০১৬ তে সমাপ্ত হয়েছে।
বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে ৪র্থ সেক্টর কর্মসূচিতে কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) অপারেশনাল প্ল্যান জানুয়ারি ২০১৭ থেকে জুন ২০২২ মেয়াদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জুন ২০১৭ সাল থেকে অপারেশন প্ল্যানভুক্ত করে কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার প্রকল্পের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম চালু রাখা হয়। কিন্তু নতুন প্রকল্প চালুর আগেই অদ্যাবধি চাকরি রাজস্ব না হওয়ায় হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন সিএইচসিপিদের অনেকে।
রীটের আবেদনের প্রেক্ষিতে কমিউনিটি ক্লিনিকে কমিউনিটি হেল্থ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তদের চাকরি প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের অনুলিপি ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। যা বাস্তবায়ন করার জন্য গত ১৮/০১/২০১৮ তারিখে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএইচসিপিএ), দাবি আদায় বাস্তবায়ন কমিটি ২০/০১/২০১৮ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করে। ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে রিক্তহস্তে কমিউনিটি বেইজ হেলথ কেয়ার সিবিএইচসি স্মারক নং- স্বা:অধি/সিবিএইচসি/প্রশাসন-২২/
আর যৌক্তিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে স্মারক নং স্বা:অধি/সিবিএইচসি/প্রশাসন/সি
দেশে ন্যায্য অধিকারের জন্য পেশাজীবীদের আন্দোলন নতুন কিছু নয়। কিন্তু একটি মহল সিএইচসিপিদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম নিরুৎসাহিত করার জন্য সাসপেন্ডকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে। কৌশলে চাকরি রাজস্বের আশ্বাসের বাস্তবায়ন না করে হাইকোর্টের রাজস্বের পক্ষে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার।
আপিল বিভাগ কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি পদের চাকরি জাতীয়করণের (রাজস্ব) বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশ সংশোধন (মডিফাই) করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। আদালত সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরে হাইকোর্টের রায় সংশোধন করে তাদের চাকরি ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন-২০১৮’ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টি বোর্ড আশ্বাসের মাধ্যমে প্রতারণা করে কৌশলে চাপে রেখেছে চৌদ্দ হাজার স্বাস্থ্য কর্মীদের।স্বাস্থ্যকর্মীদের জোর করে বিষপানের মতো কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন-২০১৮ বাতিল চায়। সিএইচসিপিরা হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী তাদের চাকরি রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তসহ বকেয়া ইনক্রিমেন্ট, ১১তম গ্রেড, তিন স্তরের পদোন্নতি ও ইন সার্ভিস ডিপ্লোমা প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
সম্প্রতি ট্রাস্ট বাস্তবায়নে ও সিএইচসিপি’র চাকরী স্থায়ী করণে তোরজোর শুরু হলেও বিপত্তি বাঁধে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বেতন গ্রেড নির্ধারণ নিয়ে। গেল ১৩ বছর পূর্বে সিএইচসিপিগণ চাকরিতে যোগদেন গ্রেড -১৪ হিসেবে। আজ ১৪ বছরে এসে যেখানে উচ্চতর গ্রেড পেয়ে ১২/১৩ হওয়ার কথা সেখানে গ্রেড অবনমিত করে ১৬ নির্ধারণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়।কি আজব চিত্র!গেল সরকার কেন রাজস্বের পথ বাদ দিয়ে ট্রাস্টের পথে হাঁটছেন? কি মধু আছে ট্রাস্টে, তা খুঁজে বের করার আহবান জানান সিএইচসিপি’রা।
কক্সবাজার জেলা সিএইচসিপি এসোসিয়েশন এর সাংগঠনিক সম্পাদক এস,এম রেজাউল করিম জানায়, ট্রাস্ট গঠনে সরকারের আলাদা ব্যায় বাড়বে,আলাদা নীতিমালা এবং দেখভালের জন্য অহেতুক জনবল নিয়োগ ও তাদের বেতন-ভাতা বাবদ অধিক অর্থের অপচয় হবে। দেশে চলমান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন নন-মেডিকেল স্বাস্থ্য নিয়োগ বিধিমালা -২০১৮ তে সিএইচসিপি পদ টি অন্তর্ভুক্ত করা হলে কোন ধরনের ব্যায় বাড়বে না,আর আলাদা প্রবিধানমালা তৈরি করতে হবে না। এটি হলে দেশের জন্য মঙ্গলজনক। গত জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত ১৪০০০ স্বাস্থ্য কর্মীর বেতন ভাতা বন্ধ রয়েছে।এরপরও সকলে তাদের দায়িত্ব পালন করে চলছে।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে গেল সরকারের পতনের পর ট্রাস্ট বাতিল চেয়ে একই প্রতিষ্ঠানে বৈষম্যহীন সকল কর্মীদের চাকরি রাজস্বকরণে দাবি তুলে গত আগস্টের ১৮ ও ১৯ তারিখ হাজার হাজার সিএইচসিপি শাহবাগ চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশ করে বর্তমান স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টার আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করে কর্মস্থলে ফিরে আসলেও গত জুলাই থেকে বেতনহীন মানবেতর জীবনযাপন করছে স্বাস্থ্য কর্মী সহ তাদের পরিবার-পরিজন।
রামু উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প কর্মকর্তা ডা. নোবেল কুমার বড়ুয়া জানিয়েছেন- রামু উপজেলায় ২৮টি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে। সারাদেশে ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে দায়িত্বরত সিএইচসিপিগণ এখন দক্ষ জনবলে রূপ নিয়েছে। সাধারণ জনগণ এসব ক্লিনিকে ডায়াবেটিস, পেশার পরীক্ষাসহ সহজে পর্যাপ্ত স্বাস্থ সেবা পাচ্ছে। তাদের চাকরি স্থায়ীকরণ করা হলে দেশের স্বাস্থ্য সেবায় আমূল পরিবর্তন আসবে। প্রাথমকি পর্যায় স্বাস্থ্য সেবা ছড়িয়ে দিতে এসব কমিউনিটি ক্লিনিক এবং সিএইচসিপিগণের কোন বিকল্প নেই। তাছাড়া দুইমাস ধরে সারাদেশের সিএইচসিপিগণের বেতন বকেয়া রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।
পাঠকের মতামত: