ঢাকা,শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪

আন্তর্জাতিক যুব দিবস ২০২৪ উপলক্ষে 

চকরিয়ায় সনাক-টিআইবির মানববন্ধন 

এমম জিয়াবুল হক, চকরিয়া ::
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে তারুণ্যের আশা-আকাঙ্ক্ষার কার্যকর প্রতিফলন চাই- দাবীকে সামনে রেখে গতকাল সোমবার (১২ আগষ্ট) আন্তর্জাতিক যুব দিবস উপলক্ষে দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির অনুপ্রেরণায় গঠিত সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চকরিয়ার উদ্যোগে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কক্সবাজার চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া পৌরশহরের  চিরিঙ্গাতে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন সনাক-টিআইবি চকরিয়ার সভাপতি ছরওয়ার জাহাঙ্গীর। টিআইবির এরিয়া কো-অর্ডিনেটর শেখ মোঃ ওবায়দুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত  মানববন্ধনে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন চকরিয়া আবাসিক মহিলা কলেজের শিক্ষক ও সানক সদস্য  বুলবুল জান্নাত, সনাক সদস্য সাংবাদিক এম আর মাহমুদ, কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চকরিয়ার অন্যতম সমন্বয়কারী মোবারক হোসেন জিহান প্রমুখ। মানববন্ধনে দিবস উপলক্ষে টিআইবির ধারণাপত্র পাঠ এবং দাবীসমূহ তুলে ধরেন ইয়েস দলনেতা সাদিয়া সোলতানা রিফাত ও সহ-দলনেতা আরমান মোহাম্মদ রাফি। মানববন্ধনে সনাক, ইয়েস ও এসিজির সদস্য ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।
মানববন্ধনে সভাপতির বক্তব্যে সনাক সভাপতি ছরওয়ার জাহাঙ্গীর, এ দেশের সকল বিপ্লবে তরুণরা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, ইতিহাসরে দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এদেশের তরুণ সমাজ সর্বদা অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যার অতুলনীয় উদাহরণ। এ দেশের তারুণ্য চরম স্বেচ্ছাচারী ও অগণতান্ত্রিক শক্তিকে কীভাবে পরাভূত ও পরাজিত করতে হয়, তারও পাঠ্যবই উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। নির্লোভ ও স্বার্থহীনভাবে কীভাবে নিজেকে উৎসর্গ করতে হয়, তার অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তরুণ শিক্ষার্থীরা। যারা জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, যারা আহত ও বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন Ñতাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। যারা এই বিজয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখনও আন্দোলনের চেতনা সমুন্নত রাখতে ও বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকার পাশাপাশি নিরলস পরিশ্রম করে রাস্তায় রাস্তায় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের তরুণদের এই দৃষ্টান্ত অনাগত দিনে বৈশ্বিক পর্যায়ের যে কোনো ন্যায়ভিত্তিক আন্দোলনের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। একইসঙ্গে ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে তারুণ্যের এই জয়রথ যেন সংকীর্ণ কোনো চোরাবালিতে আটকে না যায়, সেই লক্ষ্যে তাদের বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা সর্বোপরি তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি। সনাক সভাপতি তরুণদের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে বৈষম্যহীন, সাম্য ও মেধাভিত্তিক, গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক, সুশাসিত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহবান জানান।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, বিশ্ব যখন তরুণদের ওপর নির্ভর করে একটি টেকসই উন্নত বিশ্বে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, ঠিক সেই মুহূর্তে তারুণ্যের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে এক ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। একটি শান্তিপূর্ণ ও যৌক্তিক দাবির আন্দোলনকে প্রথমে উপেক্ষা ও পরবর্তীতে অপ্রয়োজনীয় ও নজিরবিহীন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রকাঠামোকে সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। নির্মম হত্যাকান্ড, নির্লজ্জ মিথ্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন হামলা, মামলা, গণগ্রেফতার, মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড থেকে শুরু করে জঘন্য সকল উপায় অবলম্বন করেও তারুণ্যকে বশ করতে পারেনি স্বৈরাচার। বেসরকারি হিসাবে শিশু-কিশোর, সংবাদকর্মী ও অন্যান্য পেশাজীবীসহ প্রায় চার শতাধিক শিক্ষার্থী-জনতা হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। নিপীড়ন ও নজিরবিহীন বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে তারুণ্যের নেতৃত্বে জনজোয়ারে ভেসে গিয়েছে স্বৈরাচারী সরকার, পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, রাজনৈতিক দলসহ সকল পক্ষকে এই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিতে হবেÑ তারুণ্যের শক্তিকে দমন নয়, বরং তাদের প্রাপ্য অধিকার, মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং তরুণরা তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণে, দাবি আদায়ের আন্দোলনে যাতে নির্ভার থাকতে পারেÑরাষ্ট্রকে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। একইসঙ্গে স্বৈরাচার-পতন উদযাপনের নামে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানে হামলা; মন্দির ও উপসনালয় ধ্বংসসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ, গণমাধ্যম, পুলিশবাহিনী ও পেশাজীবিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণ আচরণের মাধ্যমে তারুণ্যের এই অর্জন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতে পারেÑএ জাতীয় আত্মঘাতী গর্হিত অপরাধ প্রতিরোধে তরুণ সমাজ স্বপ্রণোদিত হয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। যে নতুন দিনের শুভসূচনা হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার আলোকে রাষ্ট্রকাঠামোর আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে এদেশের সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চয়তাসহ একটি বৈষম্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক সুশাসিত স্বদেশ বিনির্মাণে দুর্জয় তারুণ্য অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করবেÑবাংলাদেশের আপামর জনগণ সেই আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা থেকে তাদের সারথি হয়েছে।
মানববন্ধনে দিবসটি উপলক্ষ্যে সম্ভাবনাময় যুব জনগোষ্ঠীকে জাতীয় অর্জনের মূল চালিকাশক্তি বিবেচনা করে টিআইবি ও এর তরুণ অংশীজনরা বিভিন্ন দাবী উপস্থাপন করেন। উল্লেখযোগ্য দাবীসমূহ হলো-
১. তরুণদের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে বৈষম্যহীন, সাম্য ও মেধাভিত্তিক, গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক, সুশাসিত, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকলকে যার যার অবস্থান থেকে অঙ্গীকারবদ্ধ ও উদ্যোগী হতে হবে।
২. এমন রাষ্ট্রকাঠামো গড়তে হবে, যা দীর্ঘকাল লালিত কলুষিত ও দুবৃর্ত্তায়িত রাজনীতির পরাজয়ের শিক্ষা অনুসরণে বাকস্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যমসহ মানবাধিকারভিত্তিক, জনকল্যাণমূলক, অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সক্ষম হয়। রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের রাজনীতিকরণ বন্ধ করে পুরো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে এই সংস্থাসমূহ কখনোই সরকারের ক্ষমতালিপ্সা চরিতার্থের হাতিয়ারে পরিণত না হয়।
৩. বহুমাত্রিক ও বহুপর্যায়ের নজিরবিহীন ও নির্মম মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য তদন্ত নিশ্চিতে জাতিসংঘের উদ্যোগে সম্পূর্ণ স্বাধীন কমিশন গঠন করার মাধ্যমে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৪. প্রতিবাদের অধিকার, সমাবেশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিতে প্রাতিষ্ঠানিক এবং আইনি কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে।
৫. সরকারি পদ-পদবী ও জনপ্রতিনিধিত্বকে দুর্নীতির লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ-সম্পদ অর্জন ও বিস্তারের পথ চিরতরে রূদ্ধ করতে হবে।
৬. তথ্য, বাক ও মত প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করার ফ্যাসিস্ট-পদ্ধতি চিরতরে বন্ধ করার কার্যকর কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
৭. মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসহ আইনের শাসনের সঙ্গে জড়িত সকল প্রতিষ্ঠান তথা সার্বিক রাষ্ট্রকাঠামো ঢেলে সাজাতে জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৮. সকল ধরনের ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে তারুণ্য যাতে নির্ভয়ে মতামত ব্যক্ত করতে পারে তার টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৯. আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তরুণ জনগোষ্ঠীকে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত ও কারিগরিভাবে দক্ষ করে তুলতে হবে।
১০. সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে জনবল-কাঠামোতে দক্ষতার আলোকে প্রযোজ্য পরিবর্তন আনতে হবে এবং সকল চাকুরিতে নিয়োগ-প্রক্রিয়া দুর্নীতিমুক্ত, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সাম্যমূলক প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
১১. তথ্য-প্রযুক্তিতে সমাজের সর্বস্তরের তারুণ্যকে অভিগম্যতা প্রদান ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি ইন্টারনেট সহজলভ্য করা, ডিজিটাল ডিভাইস, ডেটাসহ তথ্যপ্রযুক্তিকে বৈষম্যমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, নীতিমালা প্রণয়নসহ কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।##

পাঠকের মতামত: