ঢাকা,রোববার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

মাদক ধরা নয়, ‘মাল’ কামাইয়ে ব্যস্ত কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর

pencidilএম.শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার, ২৬ জুন ॥

কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকজন তৎপর। তবে সেটি মাদক উদ্ধারে নয়, ‘মাল’ কামাইয়ে। বিভিন্ন মাদক স্পট থেকে মাসোহারা আদায়, মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেওয়াই তাদের প্রধান কাজ। অভিযানে ব্যবহার করা হয় কালো গ্লাসের গাড়ি। তাতে উঠিয়ে নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে রফাদফা করা হয়। এমন অভিযোগ উঠেছে অহরহ। লোক দেখানো অভিযান আর মাদক বিরোধী দিবসে র‌্যালী করেই দায় সারেন কর্মকর্তারা।

কক্সবাজার পর্যটন এলাকা। পাশাপাশি মিয়ানমার সীমান্তবতীয় জেলা হচ্ছে কক্সবাজার। এখানে বিশেষ করে ইয়াবা, বিলাতি মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, চোলাই মদ বিক্রির অহরহ স্পট এবং শতশত পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ি রয়েছে।

রোববার ২৬ জুন দেশের অন্যান্য স্থানের মতো কক্সবাজার জেলায়ও পালিত হয়েছে বিশ্ব মাদক বিরোধী দিবস। রোববার সকালে কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর শহরে র‌্যালী করেন। কিন্তু বছর ঘুরে দিবসটি শুধু পালন করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

অভিযোগে প্রকাশ, জেলার প্রতিষ্টিত ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারীদের কাছ থেকে তালিকা করে মাসোহারা নেওয়ার পাশাপাশি লাইসেন্সধারী মাদক ব্যবসায়ীদেরকেও নিয়মিত মোটা অংকের টাকা প্রদান করতে হচ্ছে তাদেরকে। জেলার ৩ শতাধিক মাদকস্পট সহ বিভিন্ন মাদকস্পট থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে মাদক ব্যবসা সচল রাখার অভিযোগ আছে কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময় অভিযানে ব্যবহার করা হয় কালো গ্লাসের গাড়ি। তাতে উঠিয়ে নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে রফাদফা করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা শহরের বড়বাজার, চাউল বাজার, গোলদিঘীরপাড় সহ রাখাইন পাড়াগুলো, টেকপাড়াসহ আশপাশে ১৫০ টি ঘরে বিক্রি হয় চোলাই মদ, ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল ও গাঁজা। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিঘর থেকে মাসে ২ হাজার টাকা করে নেয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর। এখানকার শতাধিক ঘরে শুধু বিক্রি হয় ইয়াবা ও হেরোইন। তাদেরকে দিতে হয় প্রতিদিন দেড়’শ টাকা করে। এমএলএসএস তৌহিদুল ইসলাম এই টাকা উত্তোলন করে পৌছে দেন ইন্সপেক্টর এর কাছে । এছাড়া সীমান্তবর্তী টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার আরো ২’শতাধিক স্পটসহ জেলার পাঁচ শতাধিক মাদকস্পট থেকে মাসোহারা উত্তোলন করা হয় বলে অভিযোগ।

অভিযোগ রয়েছে, সবচেয়ে বেশি ইয়াবা, মদ বিক্রি ও সেবন চলে এমন কিছু কটেজ ও আবাসিক হোটেলের নাম উঠে এসেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, শহরের হোটেল সাতকানিয়া, হোটেল নজরুল, ছৈয়দিয়া, নীশিথা , নিউ নিশীথা, রহমান রিসোর্ট, আল হোসাইন, সী-হার্ট, যমুনা গেস্ট হাউস , রাজমনি হোটেল, রয়েল, শাহরাজ, এশিয়া, লাইট হাউসপাড়া এলাকার মধ্যে রয়েছে, রাজিউন কটেজ, বীচ সিটি রিসোর্ট, সী গ্রীণ রিসোর্ট, ঢাকা কটেজ, শারমিন কটেজ, মায়াকানন, লাইটহাউস কটেজ, দিমান কটেজ, লিটল মুন কটেজ, ফয়সাল কটেজ, রমজান কটেজসহ আরো অন্তত ২০টি কটেজ রয়েছে যেখানে মদ নারী কারবার ও জুয়ার আড্ডা চলে প্রকাশ্যে। বিভিন্ন সময় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ইয়াবা, মদ ও নারী আটকের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। এই সব আস্তানা থেকে মাসোহারা নেয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

আরো অভিযোগ রয়েছে, জেলা শহরে লাইসেন্সধারী দেশী ও বিলাতী মদ ব্যবসায়ীদেরকেও মোটা অংকের টাকা দিতে হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের। তথ্য মিলেছে কক্সবাজার শহরের দেশী মদের দোকান থেকে প্রতিমাসে ইন্সপেক্টরকে ১০ হাজার টাকা। মাদকের স্পটগুলো থেকে সহকারী পরিচালক,অফিস খরচ হিসেবে এবং অফিস ষ্টাফদের জন্যে নেয়া হয় সব মিলিয়ে অন্তত পাঁচ লাখ টাকা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মতে, কক্সবাজার শহরে ৬টি আবাসিক হোটেল লাইসেন্সধারী ৬টি বার রয়েছে। ১টি চোলাই মদের আড়ৎ রয়েছে। এসব ব্যবসায়িরা সরকারকে রাজস্ব দিয়েই মদের ব্যবসা করছে। তাদের কাছ থেকে কোন ধরনের চাঁদা উত্তোলিত হয় না দাবী করেন তৌহিদুল ইসলাম।

সুত্র মতে, কক্সবাজার উপ-অঞ্চল কক্সবাজার জেলায় মাদকদ্রব্য সম্পর্কিত সকল কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় এর উপ-আঞ্চলিক কার্যালয় ও সদর সার্কেল অফিস অবস্থিত। রামুতে অপর একটি সার্কেল থাকলেও সম্প্রতি বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও টেকনাফে একটি সার্কেল অফিস প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মিয়ানমারের সাথে দীর্ঘ সীমান্ত থাকায় এটি ইয়াবা ও অন্যান্য অপিয়াম পাচারের প্রধান অঞ্চল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

কক্সবাজার জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সুত্রে জানা গেছে, গত ৩ মাসে কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তাদের সফলতার কথা জানালেও বাস্তবে এররূপ ভিন্নতর। চলতি বছর মে থেকে চলতি জুন পর্যন্ত পুরো জেলায় ইয়াবা, বিয়ার, গাজা ও বিলাতি মদের বিরুদ্ধে ৮৯টি অভিযান পরিচালনা করেন। এসব অভিযানে আটক করা হয় ২১ জন মাদক ব্যবসায়িকে। আটককৃতদের মধ্যে ভ্রাম্যমান আদালতে মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে ১৮ জনকে। অভিযানের বিপরীতে গত ৩ মাসে মামলা হয়েছে ৩৭টি।

এদিকে, লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, এগুলো ট্র্যাডিশনালি চলে আসছে।

মাদকের আখড়া থেকে মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা জানিয়ে সহকারী পরিচালক সুবোধ কুমার বিশ্বাস বলেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা বা কোন ব্যবস্থা নিতে গেলে প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তারা ও কতিপয় রাজনৈতিক নেতারা তদবীর করেন।

সহকারী পরিচালক বলেন- তার নামে মাসোহারা উঠে বলে তার জানা নেই।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের গোয়েন্দা শাখার তত্বাবধায়ক ইদ্রিচ আলী বলেন, মাদকের সাথে যে হোক না কেন, কাউকে ছাড় দেয়া হবে। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। টু দ্যা টুমুরো এ ব্যবসা বন্ধ হবে।

—————-

পাঠকের মতামত: