ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ায় চিংড়ী জোনে ডাকাত দলের জিজিয়া সন্ত্রাস

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :::

মুসলিম দেশে বহিরাগত বিবেচনায় অমুসলিমদের কাছ থেকে আদায় করা করকে বলা হতো জিজিয়া। ওই কর ব্যবস্থা এখন বিলুপ্ত। কিন্তু কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় চিংড়ি চাষিদের কাছ থেকে প্রতি পক্ষে (১৫ দিনে এক পক্ষ) একবার করে জিজিয়া কর তোলে চিংড়ী জোনে ডাকাত দলের সন্ত্রাসীরা। কারণ এই চিংড়ি চাষিরা অন্য জেলার বাসিন্দা (স্থানীয়দের ভাষায় বহিরাগত)।

এ উপজেলার উপকূলে ৪৫ হাজার ৫৩০ একর জমিজুড়ে রয়েছে চিংড়িঘের। প্রতি পক্ষে সন্ত্রাসীদের প্রতি ১০ একরে এক হাজার টাকা করে জিজিয়া কর দিতে হয়। এ হিসাবে প্রতি মাসে কর ওঠে প্রায় ৯০ লাখ টাকা। এ টাকা যায় প্রভাবশালীদের পকেটে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন চকরিয়ার এ জমিতে একসময় প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ম্যানগ্রোভ বন ছিল। বনের জমিতে ১৯৭৮ সাল থেকে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে বনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। অবশ্য কাগজে-কলমে বন বিভাগের রেকর্ডে চকরিয়া সুন্দরবন রেঞ্জ (সিএস রেকর্ড) থাকলেও কার্যত বনভূমি নেই, আছে শুধু চিংড়িঘের। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় মাত্র ৩৯ ধনাঢ্য ব্যক্তির নামে ভূমি লিজ দিয়ে চিংড়ি চাষের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এরপর সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমলে সামরিক অধ্যাদেশমূলে ৩৯ ব্যক্তির নামে দেওয়া লিজ বাতিল হয়। ১০, ১১ ও ৩০ একরবিশিষ্ট ঘের করে সর্বসাধারণকে চিংড়ি চাষের জন্য লিজ দেওয়া হয়। এই লিজপ্রাপ্ত বেশির ভাগ চাষি অন্য জেলার বাসিন্দা। এখানে বর্তমানে বছরে ৩৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার চিংড়ি উৎপাদন করা হয়। এ ছাড়া শত কোটি টাকার অন্য প্রজাতির মাছ উৎপাদিত হয়।

চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. সাইফুর রহমান জানান, চকরিয়া উপজেলায় ব্যক্তি ও সরকারি মালিকানায় তিন হাজার ৫৮টি চিংড়িঘের রয়েছে। এর মধ্যে খুটাখালীতে ২৫০টি, ডুলাহাজারায় ৯৫টি, সাহারবিলে ৫০৪টি, চিরিঙ্গায় এক হাজার পাঁচটি, কোনাখালীতে ৭০টি, বদরখালীতে ২০২টি, পশ্চিম বড় ভেওলায় ২০০টি ও ঢেমুশিয়া ইউনিয়নে ৪৫টি ঘেরের অবস্থান। মৎস্য মন্ত্রণালয়ের মালিকানায় রয়েছে ৫৮৭টি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চিংড়ি চাষি জানান, চিংড়িঘেরে প্রতিপক্ষে দুইবার মাছ ধরা হয়। যাকে চাষিরা স্থানীয় ভাষায় জো বলে। প্রতি জোতে ১০ একর ঘেরের জন্য এক হাজার, ২০ একরের জন্য দুই হাজার ও ৩০ একরের জন্য তিন হাজার টাকা দিতে হয় ডাকাত দলের স্থানীয় সন্ত্রাসীদের। সন্ত্রাসীরা এ টাকা ‘জিজিয়া’ হিসেবে নিয়ে থাকে। এ টাকা যথাসময়ে পরিশোধ না করলে জোতে পাওয়া মাছ লুট করে নিয়ে যায়। এ নিয়ে প্রতিবাদ করার কোনো উপায় থাকে না।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, চকরিয়ার চিংড়ি অঞ্চলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন প্রায় সাত হাজার একর ঘের রয়েছে। এসব জমি এখনো রাজনৈতিক ও দখলবাজ ভূমিদস্যুদের কবলে থাকায় সরকার কোনো রাজস্ব পায় না।

অবশ্য স্থানীয় সূত্র জানায়, ভূমি ও মৎস্য মন্ত্রণালয়ের এসব চিংড়ি জমির দখল-বেদখল নিয়ে প্রতিনিয়ত সংঘাত-সংঘর্ষ চলে আসছে। মূলত এ জমি যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, সেই সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

চকরিয়ার বৃহৎ চিংড়ি চাষি ও উপজেলা বিত্তহীন সমবায় সমিতির (বিআরডিবি) চেয়ারম্যান মো. সেলিম উল্লাহ বলেন, চিংড়িঘের এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থা একেবারে সেকেলে। এই অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে সশস্ত্র চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী ও ডাকাতরা বিনা বাধায় লুটপাট করে পার পেয়ে যাচ্ছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘চিংড়ি চাষ এলাকায় অপরাধকর্মে অগ্রভাগে রয়েছে চিরিঙ্গা ইউনিয়নের সওদাগর ঘোনা ও পালাকাটা, ডুলাহাজারা ইউনিয়ন, খুটাখালী ইউনিয়ন এবং সাহারবিল ইউনিয়নের রামপুর ও কোরালখালীর অন্তত ডাকাত দলের দেড় শতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী। এসব ডাকাত দলের সন্ত্রাসী সরকারি দলের অসংখ্য নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে অপকর্ম করছে। ’

চকরিয়া থানার ওসি মো. বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘চিংড়ি অঞ্চলের অবস্থা আগে থেকেই তেমন ভালো ছিল না। এর পরও আমি এ থানায় যোগদান করার পর থেকে একের পর এক সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করছি। এই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র, বেশ কয়েক রাউন্ড গুলিসহ কয়েকজন চিহ্নিত ও দাগি দুর্ধর্ষ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছি। ’ ওসি জানান, বিশাল এলাকা, অথচ যোগাযোগব্যবস্থা একেবারে ভালো নয়। কোনো সংবাদ শোনামাত্র ঘটনাস্থলে পৌঁছানো যায় না। তা ছাড়া অন্য পন্থায় সেখানে পৌঁছার আগেই অপরাধীরা নৌপথে পালিয়ে যায়। চিংড়িঘেরের নিরাপত্তায় রামপুর পুলিশ ফাঁড়ি থাকলেও তাত্ক্ষণিক অভিযান চালানোর জন্য নৌযান নেই। শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়েই পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। এরই মধ্যে ঘের এলাকার ত্রাস কোরালখালীর লুত্ফুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য যেসব সন্ত্রাসী-ডাকাত ঘেরে তাণ্ডব চালানোর মতো অবস্থায় রয়েছে, তাদের তালিকা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।

চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম বলেন, ‘এ বিষয়ে জেলা ও উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা সভায় বলেছি। প্রকৃত চিংড়ি চাষিদের বাদ দিয়ে বহিরাগতদের জমি লিজ দেওয়ায় সমস্যা বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে যারা চিংড়ি চাষি নয়, তাদের নামে দেওয়া লিজ বাতিল করে পুনরায় বরাদ্দ দেওয়া হলে চাঁদাবাজি-ডাকাতির মতো ঘটনা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। এর পরও চিংড়িঘেরে চাষিরা যাতে নির্বিঘ্নে মাছ উৎপাদন করতে পারে, সে জন্য সব সহায়তা দেওয়া হবে। ’

কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ইলিয়াছ জানান, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও চাষিরা নানা প্রজাতির মাছ উৎপাদন করছে। সন্ত্রাসীদের নির্যাতন ও চাঁদাবাজি থেকে নিরীহ চাষিদের রক্ষায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো বেশি তৎপর হতে হবে।

পাঠকের মতামত: