ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

জেলায় ৬৮টি অবৈধ ইটভাটা, বিপন্ন পরিবেশ

জহিরুল আলম সাগর, চকরিয়া :: কক্সবাজারে সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর অবৈধ ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে। ইতিমধ্যে চকরিয়া, ঈদগাঁও, রামু, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, উখিয়াসহ জেলার সব জায়গায় অভিযান চলমান রয়েছে। অবৈধ ইটভাটায় গিয়ে জরিমানা করাও হচ্ছে কিন্তু বন্ধ করার কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।
ইটভাটাগুলো কোন অদৃশ্য শক্তির বলে কোনভাবেই বন্ধ করতে পারছেনা স্থানীয় প্রশাসন। লোক দেখানো কয়েকটি অভিযানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে এইসব কার্যক্রম। অন্যদিকে অবৈধ ইটভাটা ব্যবসায়ীরা অভিযান চলাকালিন সময়ে গা ড়াকা দিয়ে থাকলেও অভিযান পরিচালনাকারী দল চলে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের ইট তৈরির কাজ শুরু হয় পুরোদমে।

জেলায় ১১১ টি ইটভাটা থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের বৈধতা আছে বলে জানান ৪৩টির।
গত সোমবার (১১ ডিসেম্বর) থেকে কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় এসব অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়।
অভিযানে নেতৃত্ব ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র সহকারী সচিব ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সাদিকুর রহমান সবুজ।
রামু কলেজ গেইটের হাজী গোলাম মওলা জানান, পরিবেশ আইনে জনবসতি থেকে দূরে ইটভাটা করার নীতিমালা থাকলে আমার বাড়ির পাশের ইটভাটা কি নীতিমালা মেনে করেছে? যদি পরিবেশ আইন নীতিমালা মেনে না চলে তা হলে এই ইটভাট কিভাবে চলছে? ইটভাটার ধুলো ও ধোয়ার কারনে বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ রাখতে হয়।

পরিবেশবাদীরা বলছে, নিয়মনীতি না মেনেই অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। অবৈধভাবে কৃষি জমিতে ইটভাটা তৈরির কারণে কমছে চাষাবাদের জমি। এছাড়া, ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারে কমছে গাছ। ফলে বিরান ভূমিতে পরিণত হচ্ছে বনাঞ্চল।

পরিবেশ আইন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা প্রস্তুত আইন অনুযায়ী সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি ও কৃষিজমিতে ইটভাটা তৈরি করা যাবে না। এছাড়া, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা সদর এলাকায়ও ইটভাটা তৈরি করা যাবে না। অন্যদিকে ইট তৈরির জন্য কৃষিজমি, পাহাড়, টিলা থেকে মাটি কেটে কাঁচামাল হিসেবে এবং জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারও নিষিদ্ধ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার অঞ্চল এর সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক ফজলুল কাদের চৌধুরী জানান, কক্সবাজার এখন ইটভাটার শহরে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ আইন অমান্য করে তারা ইটভাটা তৈরি করছে। এদের বিরোদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করছি। অন্যথায় বাপা আন্দোলনের ডাক দিকে।

একদিকে ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ ও অতিরিক্তি মাত্রার সালফারযুক্ত কয়লা ব্যবহার হচ্ছে। কাঠ ব্যবহারের ফলে গাছের সংখ্যা কমছে। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। পরিবেশ আইন অমান্য করে গড়ে উঠা এসব ইটভাটার কারণে কমে যাচ্ছে পাখির অভয়ারণ্য, কৃষি জমি ও উজাড় হচ্ছে বিশাল বনভূমি। ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়সহ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। ইটভাটার কালো ধোঁয়ার কারণে ফুসফুসের সমস্যা, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগ হতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় বয়স্ক ও শিশুরা। ইটভাটার ধোঁয়ায় নষ্ট হচ্ছে গাছের ফল ও পাখির আবাস।

এদিকে মৌসুম ভিত্তিক অভিযানে গত বুধবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ে ৬টি অবৈধ ইটভাটা ধ্বংস করা হয়েছে। হোয়াইক্যং ডিংগাকাটা এলাকায় এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযান চলাকালে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে পাহাড় কেটে অবৈধভাবে ইটভাটা প্রস্তুত ও পরিচালনার দায়ে, ইট প্রস্তুত এবং ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ (সংশোধিত-২০১৯) মোতাবেক ৬টি অবৈধ ইটভাটা ধ্বংস করা হয়। এছাড়াও হোয়াইক্যং এ.এইচ.বি ব্রিকস এক ১০ লক্ষ, একই এলাকার এম.কে.বি’কে ৬ লক্ষ, এ.আর.বি’কে ৬ লক্ষ, এস.এম.বি’কে ৬ লক্ষ, এম.আর.বি’কে ৩ লক্ষ ও পি.বি.সি’কে ৬ লক্ষ টাকা সর্বমোট ৩৭ লক্ষ টাকা জরিমানাসহ প্রত্যেকটি ইটভাটা ধ্বংস করা হয়।
চিমনি বিশিষ্ট ভাটা ২০০১ সাল থেকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। বেশির ভাগ ড্রাম চিমনি বিশিষ্ট ভাটা রয়েছে রামু, চকরিয়া এবং উখিয়ায়। এগুলো নির্মান করা হয়েছে নদীর কাছে, উপকূল, পাহাড়ি ও জনবহুল এলাকায়। এসব ভাটায় জমির উপর স্তরের মাটি ব্যবহার করায় জমির উর্বিরা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে, কমছে ফসল উৎপাদন ক্ষমতা বিশেষজ্ঞদের মতে, জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ফেলা হলে আগামী ২০ বছরেও সেই জমির প্রয়োজনীয় জৈব পদার্থের ঘাটতি পূরণ হবে না। ফসলি জমির মাটির উপরি অংশ কাটা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে জমির ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকাংশে কমে যাবে। এতে হুমকির মুখে পড়বে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র সহকারী সচিব ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সাদিকুর রহমান সবুজ জানান, পরিবেশ ছাড়পত্র ও ইট পুড়ানোর ছাড়পত্র না থাকায় অবৈধ ইটভাটা ধ্বংসে দেশব্যাপী অভিযান চলছে। এর অংশ হিসেবে কক্সবাজারের অভিযান শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকল অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।

অপরদিকে জেলায় ৪৩ টি ইটভাটার সর্ম্পকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশ গুপ্তা জানান, জেলায় যে ইটভাটাগুলোর বৈধতা আছে সেখানে অনেক ভাটা মালিক তা আপডেট রাখেনি। আবার অনেকে নীতিমালার বাইরে এসে কার্যক্রম চালাচ্ছে নিজেদের মত করে। আবার অনেক ইটভাটার চিমনি এখনও উন্নত প্রযুক্তিতে রুপান্তর করা হয়নি।

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মোঃ নাজমুল হুদা জানান, অনেক ভাটায় মামলার কারণে মূলত আমরা অভিযান চালাতে পারছিনা। ভাটার মালিকরা ২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ইটভাটা প্রস্তুত আইনে হাইকোর্টে একটি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রায় ইটভাটা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ ভাটা চিহ্নিত করে আমাদের টিম অভিযান চালাচ্ছে।

কক্সবাজারের ৮ উপজেলায় ১১১টির মত ইটভাটা আছে। এর মধ্যে ৬১.২৬ শতাংশের পরিবেশের ছাড়পত্র ও অনুমোদন নেই। আছ মাত্র ৩৮.৭৩ শতাংশের পরিবেশগত ছাড়পত্র । জেলায় অবৈধ ও বৈধ ইট ভাটার পরিসংখ্যান হলো কক্সবাজার সদরে ১৯টির মধ্যে বৈধ মাত্র ৩টি, অবৈধ ১৬ টি। রামুর ৫২টির মধ্যে বৈধ ২৩টি অবৈধ ২৯ টি। পেকুয়ার ৬টির মধ্যে বৈধ মাত্র ১ টি, অবৈধ ৫টি।
কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে অনুমোদনহীন ইটভাটা বন্ধ জরুরি হয়ে দাড়িয়েছে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীগণ।

এ ব্যাপারে প্রশাসনের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন সচেতন মহল।

পাঠকের মতামত: