ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

প্রক্রিয়া শুরু চসিকের : বিকল্প স্থানে গড়ে তোলার পরিকল্পনা

অবশেষে উচ্ছেদ হচ্ছে শিশু পার্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্রগ্রাম ::   উচ্ছেদ করা হচ্ছে সার্কিট হাউস সংলগ্ন শিশু পার্কটি। এ লক্ষ্যে প্রক্রিয়াও শুরু করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জায়গায় স্থাপিত শিশু পার্কটি উচ্ছেদে দীর্ঘদিন ধরেই দাবি ছিল সামরিক ভূমি ও সেনানিবাস অধিদপ্তরের। নগরের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজনও বারবার বলে আসছিলেন, পার্ক উচ্ছেদ করে জায়গাটি উন্মুক্ত করা হোক। অবশ্য ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশে উচ্ছেদের উদ্যোগও নেয়া হয়। ওই সময় পার্কের ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মেয়াদ বহাল থাকায় উচ্ছেদ করা হয়নি। তবে গত বছর চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও চলতি বছর নতুন করে ১৫ বছরের জন্য ইজারাদার নিয়োগ করে চসিক। এদিকে শিশু পার্কটি উচ্ছেদ করা হলেও বিকল্প স্থানে নতুন করে আরেকটি পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে চসিকের। বর্তমান ইজারাদার প্রতিষ্ঠানকে বিকল্প স্থানে পার্ক করার প্রস্তাব দেয়া হবে। বিকল্প পার্কের জন্য প্রাথমিকভাবে পাহাড়তলী ও খুলশী এলাকায় দুটি পরিত্যক্ত জায়গা বাছাই করা হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসনের একটি প্রতিনিধি দল গতকাল পাহাড়তলী এলাকার ২৮ একর জায়গাটি পরিদর্শনও করেন। জায়গাটির মালিক ভিন্ন সংস্থা। তবে সিটি কর্পোরেশনকে পার্ক গড়ে তোলার জন্য তাদের পছন্দের ভূমি অনুমোদন দেয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি নীতিগত সিদ্ধান্তও আছে। চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বিষয়গুলো নিশ্চিত করে দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল জায়গাটি (বর্তমানে যেখানে শিশু পার্ক রয়েছে) উন্মুক্ত থাকুক, সবুজ থাকুক এবং সেখানে যেন কোন স্থাপনা বসানো না হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবেও চাই এটি খোলা থাকুক। তবে এখন যেহেতু ইজারাদারের সাথে চুক্তি আছে, তাই বিকল্প স্থানে পার্কটি সরিয়ে নিবো। এজন্য আমরা দুটি জায়গা বাছাই করেছি। জেলা প্রশাসন এবং আমাদের অফিসার জায়গাগুলো পরিদর্শন করেছেন। জায়গাটি অন্য মন্ত্রণালয়ের। তবে আমাদের অধিগ্রহণ দেয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সাথে আমার কথা হয়েছে। চট্টগ্রামের মন্ত্রীগণও ডি ও লেটার দিবেন।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে খোরশেদ আলম সুজন বলেন, শিশু পার্কের নামে জঞ্জাল চাই না। শিশুদের জন্য সত্যিকারের বিনোদন স্পট ও তাদের বিকাশের জন্য পরিবেশ চাই। সেজন্যই বিকল্প জায়গা বেছে নিচ্ছি। বিকল্প জায়গায় পার্ক করে বর্তমান শিশু পার্কের জায়গাটি উন্মুক্ত রাখবো। সেখানে সাধারণ মানুষ সবুজের নিঃশ্বাস নিতে পারবেন। ১১ বছর ধরেই চলছে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া :

২০০৯ সালের ৬ মে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তৃতীয় সভায় শিশু পার্কটি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির তৎকালীন সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন স্বাক্ষরিত সভার ২৩ নং সিদ্ধান্তের ঙ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়, ‘চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের সামনের শিশু পার্ক তুলে দিতে হবে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও পর্যটন কর্পোরেশন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে’।

পরবর্তীতে একই বছরের ১৪ অক্টোবর চসিকের পক্ষ থেকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নিকট এক পত্রে শিশু পার্ক তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল।

এদিকে ২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সভায় তৎকালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ জেলা প্রশাসককে পার্কটি বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই সময় বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বপ্রাপ্ত) নিজেই সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছেন পার্কটি উচ্ছেদে ব্যবস্থা নিতে। বিষয়টি নিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকও করেন ওইসময়। পরবর্তীতে একই বছরের এপ্রিল মাসে জেলা প্রশাসনের একটি প্রতিনিধি দল বিষয়টির অগ্রগতি খতিয়ে দেখতে চসিকের স্টেট বিভাগের সাথে কয়েক দফা বৈঠকও করেছিলেন।
পার্কটির পেছনের ইতিহাস :

১৯৯২ সালের ১৩ জুলাই নগরীর কাজীর দেউড়ি সার্কিট হাউসের সামনে তিন একর জায়গার উপর শিশুপার্ক স্থাপনে চসিককে অনাপত্তি দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। একই বছর চসিক শিশু পার্ক স্থাপনের জন্য ঐ জায়গাটি ‘ভায়া মিডিয়া বিজনেস সার্ভিসেস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ২৫ বছরের ইজারা দেয়। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। তবে গত ১২ ফেব্রয়ারি আবারো ১৫ বছরের জন্য ‘ভায়া মিডিয়া বিজনেস সার্ভিসেস’ এর সাথে চুক্তি করে সিটি কর্পোরেশন। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি মাসে চসিককে রাজস্ব বাবদ দেড় লাখ টাকা পরিশোধ করার কথা প্রতিষ্ঠানটির। এমন সময়ে সিটি কর্পোরেশন নতুন করে চুক্তি করে যখন পার্কটি উচ্ছেদের দাবি জোরালো হচ্ছিল।
জমি ফেরত চেয়েছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় :

চসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ২৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের এক্সিকিউটিভ অফিসার মোহাম্মদ নুরুল আবছার স্বাক্ষরিত এক পত্রের মাধ্যমে সেনাবাহিনী নিজেদের জমি ফেরত চান। ওই পত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘শর্তাবলী ভঙ্গ করে চসিক তৃতীয় পক্ষ ভায়া মিডিয়া বিজনেস সার্ভিস লি. নামে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জিয়া শিশু পার্ক স্থাপনকল্পে চুক্তিপত্র সম্পাদন করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি শিশু পার্ক এলাকায় অননুমোদিতভাবে অফিস ভবন, দোকান, হোটেল ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণপূর্বক বাণিজ্যিক ভিত্তিক ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন জনের নিকট ভাড়া প্রদান করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পত্রে সন্নিবেশিত শর্তাদি সম্পূর্ণভাবে লক্সঘন করেছে। যার ফলে উক্ত এলাকায় যানজট, বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এ অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ পার্শ্বে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামগ্রিক নিরাপত্তা ও সৌন্দর্য বিঘ্নিত করছে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে চসিককে পার্ক স্থাপনের নিমিত্তে প্রদত্ত ৩ একর জমি সেনা কর্তৃপক্ষের নিকট ফেরত প্রধানের কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো’।
ইজারাদারের বক্তব্য :

শিশু পার্কটির জেনারেল ম্যানেজার নাসির উদ্দিন বলেন, উচ্ছেদ করার বিষয়টি আমাদের জানা নেই। সিটি কর্র্পোরেশন থেকে আমাদের নোটিশ দিলে তখন আমরা আলাপ-আলোচনা করবো। আপিল করবো। এখানে আমরা কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছি। এ অবস্থায় উচ্ছেদ করলে তো বেকায়দায় পড়বো। বিকল্প স্থানে পার্ক করার সুযোগ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবকিছু কি আমরা ওখানে স্থানান্তর করতে পারবো? অবকাঠামোর যে উন্নয়ন সেগুলো কি নিয়ে যাওয়া সম্ভব?

তিনি বলেন, একজন অনুমতি দিলেন এবং আরেকজন উচ্ছেদ করলেন। এভাবে হলে তো মানুষ ইনভেস্ট করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। সাবেক মেয়রও প্রথমে আমাদের সাথে চুক্তি নবায়ন করতে চাননি। তাকে আমরা আমাদের যুক্তি তুলে ধরেছিলাম। পরে তিনি অনুমতি দেন, তবে অনেকগুলো কঠিন শর্তও দেন। যে কারণে আমাদের ৪০-৫০ কোটি টাকা ইনভেস্ট করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় উচ্ছেদ করলে আমরা বেকায়দায় পড়বো।

 

পাঠকের মতামত: