ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

শহর ছাড়ছে কর্মহীন মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক ::  নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের সৈয়দশাহ রোডস্থ ব্যাংক কলোনির চারতলা ভবনের একটি ফ্ল্যাটে ৮৫০০ টাকায় ভাড়া থাকতেন মহসিন কলেজের একাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের ছাত্র ফরহাদসহ বিভিন্ন কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের সাত ছাত্র। তাদের মধ্যে ছয়জনই মূলত টিউশনি করেই ভাড়া দিতেন এবং নিজের দৈনন্দিন খরচ মেটাতেন। গত ২৬ মার্চ থেকে দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হওয়ার আগেরদিন তারা গ্রামের বাড়ি চলে যান। কলেজ কবে খুলবে তার কোন সুনির্দিষ্ট তারিখ না পাওয়ায় তারা চট্টগ্রাম শহরে আর আসেনি। এদিকে, গত সপ্তাহে বাড়িওয়ালার স্ত্রী ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন, তোমরা আসলে আস। না এলে তোমাদের মালপত্র বাইরে ফেলে দেব। বাড়িওয়ালার কড়া বার্তা পেয়ে তারা চকরিয়া থেকে এসে মালপত্র এক আত্মীয়ের বাসায় রেখে আবার চলে গেছে।
সম্প্রতি ইয়ং পাওয়ার ইন সোস্যাল একশন’র একটি জরিপে উঠে এসেছে, ১৮.৭ শতাংশ মানুষ কর্মহীন হয়ে ঘরে বসে আছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দিনমজুর। তাদের ৬৫ শতাংশ কর্মহীন। পরিবহন শ্রমিক কর্মহীন হয়েছে ১২.৭ শতাংশ। ছোট ব্যবসায়ী ১১.৭ শতাংশ, গামের্ন্টস শ্রমিক ৩.৪ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বন্দর নগরীতে বাসা ছেড়ে দেয়া এবং বাড়িওয়ালার সাথে ঝগড়া এখন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। অনেক ভাড়াটিয়া গ্রামে চলে যাচ্ছেন। আয় না থাকায় ভাড়াও দিতে পারছেন না। এদিকে, অনেক বাড়িওয়ালা আছেন তারা হয়তো ওই ভাড়া দিয়েই সংসার চালান। আবার কারো কারো ব্যাংক ঋণ রয়েছে। ভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে ঝামেলা লাগছে প্রতিনিয়ত। নগরীর আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে বস্তি সব জায়গায় প্রতিদিন কোন না কোন বাসা খালি হচ্ছে। গ্রামে ছুটছে কর্মহীন মানুষ। কারণ কারো করো আয় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কারো আয় কমে গেছে। যা দিয়ে হয়তো পরিবারকে শহরে রাখতে পারছে না। একারণে আবাসিক এলাকাসমূহে ‘টু লেট’ এর সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। কোন কোন ভবনে টু লেট লেখা একাধিক সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেছে। ভাড়াটিয়া পেতে অনিশ্চয়তার কারণে কোন কোন বাড়িওয়ালা ভাড়া কমাতেও রাজি হচ্ছেন। কোন কোন ভাড়াটিয়া আগের বাসা ছেড়ে সুবিধাজনক এলাকায় তুলনামূলক কম ভাড়ায় বাসা নেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করছেন না।
একাধিক ছোট ব্যবসায়ী যারা নগরীর ভাড়া বাসায় থাকেন, আলাপকালে তারা জানান, লকডাউনের পর থেকেই ব্যবসা নেই। বেশির ভাগ সময় দোকান বন্ধ ছিল। এখন খুলেছেন। কিন্তু ক্রেতা নেই। দোকানের দৈনন্দিন খরচও উঠছে না। এই শহরে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তবে এই সময়ে বাড়িওয়ালারা কিছুটা নমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছেন। ভাড়ার জন্য খুব বেশি তাড়া দিচ্ছেন না। কৌশলগত কারণে কেউ ভাড়াটিয়া হারাতে চাইছেন না বলেই এই নমনীয় মনোভাব বলে তারা মনে করেন। তাছাড়া নি¤œ আয়ের মানুষ যারা ফুটপাতে কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের হকারি করতেন তাদের অবস্থা আরো বেশি শোচনীয়। কেউ কেউ বিকল্প ব্যবসা হিসেবে স্যানিটাইজার, মাস্ক, পিপিই ইত্যাদি ভ্যানে বিক্রি করে কোনভাবে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন। তবে অনেকেই শহর ছেড়েছেন।
জানতে চাইলে এশিয়ান হাউজিং সোসাইটির যুগ্ম সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, ব্যাচেলর ভাড়াটিয়াদের মধ্যে বেশিরভাগই বাসা ছেড়ে দিয়েছে। ব্যাচেলররা ভাড়া নিয়েও ঝামেলা করছে। অনেক শালিস-বিচার হচ্ছে। এছাড়া প্রচন্ড কষ্টে আছেন ছোট এবং মাঝারি ব্যবসায়ীরা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচলের নির্দেশনা দিয়ে লকডাউন খুলে দেয়ার পরও তাদের ব্যবসা হচ্ছে না। ভাড়া দেয়া তো দূরের কথা সংসার চালাতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাদের। অনেকের মাসের পর মাস ভাড়া জমে যাচ্ছে। পরিস্থিতি কবে ভাল হবে তাও বুঝা যাচ্ছে না। বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়া দুইজনই অনিশ্চয়তার মাঝে আছেন। এভাবে চলতে থাকলে যেসব বাড়িওয়ালা শুধুমাত্র ভাড়ার উপর নির্ভরশীল তারাও বিপাকে পড়বেন।
জানতে চাইলে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন জানান, সিটি কর্পোরেশন আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, কারো বাড়ি খালি থাকলে, তিনি যদি সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের রাজস্ব সার্কেলে জানান, তাহলে ভাড়াটিয়া না পাওয়া পর্যন্ত তিনি ওই খালি বাড়ির জন্য গৃহকর মওকুফ পাবেন। অর্থাৎ খালি ঘরের জন্য গৃহকর দিতে হবে না। তবে অবশ্যই বিষয়টি রাজস্ব বিভাগকে জানাতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হল অলসতার কারণে অনেক বাড়িওয়ালা বিষয়টি রাজস্ব বিভাগকে অবহিত করেন না। তিনি সবাইকে যথাযথ গৃহকর দিয়ে সিটি কর্পোরেশনের সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সুযোগ দানের আহ্বান জানান।

পাঠকের মতামত: