ঢাকা,বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

করোনার বন্দিদশায় আটকা পড়েছে ঈদের কেনাবেচা

শাহীন মাহমুদ রাসেল ::  প্রতি বছর ঈদকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন কক্সবাজারের পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। কারণ ঈদ মানেই নতুন পোশাক। বাঙালির ঘরে ঘরে ছেলে-বুড়ো, তরুণ-তরুণী, মা-বোন সবার জন্য চাই নতুন পোশাক। ফলে ঈদের এক মাসেই বছরের বাকি ১১ মাসের সমান বেচাকেনা হয়।

২৫ লাখের অধিক অথবা তার কাছাকাছি মানুষের এই জেলায় ঈদ উপলক্ষে কয়েক কোটি টাকার পোশাকের চাহিদা থাকে। শবেবরাত থেকে শুরু হয়ে এই বেচাকেনা চলে ঈদের আগের রাত পর্যন্ত। এ জন্য ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীদের হাসিও চওড়া হতে থাকে। তবে এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে ঈদবাজারের পরিবেশ ঠিক উল্টো। লকডাউনের বন্দিদশায় আটকা পড়েছে ঈদের কেনাবেচা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঈদ যত কাছে আসছে, ব্যবসায়ীদের কপালের ভাঁজ তত বাড়ছে।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমিত রোগী চিহ্নিত হয়। এ ভাইরাসের বিস্তার রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ওই সময় থেকে দেশব্যাপী লকডাউন চলছে। মানুষের যাতায়াত সীমিত করে ঘরে থাকার অনুরোধ করা হচ্ছে। যানবাহন চলাচল, কলকারখানা, দোকানপাট বন্ধ। জরুরি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া অন্য সব দোকানই বন্ধ। সাধারণত মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। প্রতিদিনই দেশের মতো কক্সবাজারেও ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। ফলে কবে নাগাদ সবকিছু স্বাভাবিক হবে তা অনিশ্চিত। এমন পরিস্থিতিতে আসছে ঈদ। এ অবস্থায় ঈদ নিয়ে ব্যবসায়ীদের আশা একরকম হতাশায় পরিণত হয়েছে।

কক্সবাজারে পোশাকের বাজার কত, কত মানুষ উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণনে জড়িত তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে ২৫ লাখের অধিক মানুষের জেলায় বাজার যে বিশাল এবং এর সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ জড়িত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেউ সুতা বানান, কেউ সুতা থেকে কাপড় বানান, কেউ কাপড় থেকে পোশাক বানান, কেউ কাপড় রং করেন, কেউ পোশাকের বিজ্ঞাপন করেন, কেউ পোশাকের মোড়ক সরবরাহ করেন, কেউ পাইকারি বিক্রি করেন তো কেউ খুচরা বেচেন- এমন হরেক রকম কাজ রয়েছে পোশাককে কেন্দ্র করে। আবার বিদেশ থেকে পোশাক আমদানি করেও বিক্রি করেন একশ্রেণির ব্যবসায়ী। অন্যান্য বছর শবেবরাতের পর থেকেই ঈদের কেনাবেচা শুরু হলেও এ বছর সবই বন্ধ। সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছেন।

জেলায় পোশাকের বাজারের বড় সরবরাহ হয় কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন পাইকারি দোকান থেকে। এখানকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঢাকার হাজার হাজার কারখানা থেকে জিন্স ও গ্যাবার্ডিন কাপড়ের শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, সালোয়ার-কামিজ ও বাচ্চাদের হরেক রকম তৈরি করা পোশাক ঢাকা থেকে এনে জেলার বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। আবার বিভিন্ন উপজেলার ছোট ছোট ব্র্যান্ড যাদের একটি বা দুটি শোরুম রয়েছে, তারাও এখান থেকে নিজস্ব ডিজাইন ও কাপড়ে পোশাক নিয়ে যায়। এ ছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে শাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক আসে কক্সবাজারে।

বিভিন্ন উপজেলার কিছু কারিগর স্থানীয় কিছু ব্র্যান্ডকে বিভিন্ন ধরনের পোশাক বানিয়ে সরবরাহ করে। আবার কিছু ব্র্যান্ড রয়েছে যাদের রয়েছে নিজস্ব কারখানা। সব পর্যায়ে বর্তমানে কার্যক্রম বন্ধ। বিক্রি করার ব্যবস্থা না থাকায় কেউ কারও কাছ থেকে পণ্য কিনছেন না।

কক্সবাজার দোকান মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, ঈদ সারাদেশের মতো কক্সবাজারেও পোশাক ব্যবসায়ীদের কাছে বড় আকর্ষণ। কিন্তু এ বছর তা হতাশায় রূপান্তরিত হয়েছে। কক্সবাজার শহরেও পাঁচ শতাধিক দোকান রয়েছে। ইতোমধ্যে এসব দোকান মালিকরা কোনো ধরনের ব্যবসা না করে কর্মীদের বেতন, দোকান ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল বাবদ অনেক লাখ টাকার পুঁজি হারিয়েছেন। এ ছাড়া কাপড় থেকে শুরু করে পাইকারি ব্যবসায়ী সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছেন। এতে শত শত ব্যবসায়ী ও কর্মী অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন।

কক্সবাজার শহর এলাকা। গত কয়েক বছর ধরে এ এলাকায় শত শত নতুন দোকান গড়ে উঠেছে, যেগুলো মূলত অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য পোশাক এনে সাপ্লাই করতো।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ বাজারের দোকানগুলোতে বড় অংশের জোগান দিচ্ছে এই বড় বড় পাইকারী দোকানগুলো। প্রতি বছর রমজানের আগে বেচা-বিক্রির চাপে ঘুম হারাম হয়ে যায় শহরের অধিকাংশ দোকানের কর্মীদের। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি ভিন্ন। অন্যান্য বছর যে সময়ে দম ফেলার সুযোগ পেতেন না ব্যবসায়ী ও কর্মীরা, এ বছর সেই সময়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই তাদের। লাভের আশায় অন্যান্য বছর যাদের চোখ ঝলমল করত, এ বছর সেই চোখগুলোই লোকসানের ভয়ে ঝাপসা হয়ে আসছে।

ভাই ভাই টেইলাসের মালিক ওবাইদুল হক বলেন, এ সময় কারখানাগুলোতে বিরামহীন কাজ চলত। এ বছর তা হচ্ছে না। ফলে হাজার হাজার টাকার লেনদেন বন্ধ রয়েছে।

ফ্যামিলি মার্টের মালিক আবুল কালাম বলেন, এ বছর বৈশাখী পোশাক বিক্রি হয়নি। ঈদের বেচাকেনাও অনিশ্চিত।

ফিরোজা শপিং কম্পপ্লেক্সের মুক্তা ফেব্রিক্স এর স্বত্বাধিকারী কনক বলেন, ব্যবসায়ীরা ব্যাপক সংকটে পড়েছে। পিএমখালী বস্ত্রবিতানের মালিক আবদুর রশিদ বলেন, ভাল কিছু আশা করেছিলাম এবারের ঈদে কিন্তু করোনার কারণে তা আর হলোনা।

অনেকে আছেন নিজের পছন্দমতো পোশাক পরেন। এ জন্য বাজার থেকে কাপড় কিনে নিয়ে যান দর্জির দোকানে। ঈদের আগে এ খাতেও ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলে। বেচাকেনা বাড়ে ছিটকাপড়ের। এখন এ সবই অচল।

কক্সবাজার শহরের লেডিস টেইলার্স তরুণীর মালিক কাজী বেলাল বলেন, প্রতিবছর শবেবরাতের আগেই ব্যাপক পরিমাণে অর্ডার হয়। পাঁচটি মেশিনে চাঁদরাত পর্যন্ত টানা কাজ চলে। এ বছর তার কিছুই নেই। কর্মীরা সবাই ছুটিতে বাড়িতে গেছেন। বড় বাজারের ব্যবসায়ী খুকন বলেন, দোকান বন্ধ থাকলে বিক্রি হবে কীভাবে?

পাঠকের মতামত: